Alapon

পহেলা বৈশাখ ও আমাদের সংস্কৃতিঃ একটি পর্যালোচনা

পহেলা বৈশাখকে বলা হয় বাঙ্গালী জাতির সর্বজনীন উৎসব। এটি বাঙ্গালীর আবহমানকাল তথা হাজার বছরের শাশ্বত ঐতিহ্য। এ জাতীয় অনেক অভিধা দিয়ে এটিকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা চলছে। মূলত এ সবই হচ্ছে জঘন্য মিথ্যাচার। ইতিহাসের ভয়াবহ বিকৃতি। সত্যের মারাত্মক অপলাপ। উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিকে ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতিতে পৌত্তলিক বানানো। কিংবা পৌত্তলিকদের সেবাদাস বানানো। এগুলো যে কত বড় মিথ্যা, তা নিম্নের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হবে।

বাংলা সনের জন্মকথা:



মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তক। রাজ্যের সব কাজ হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে করা হলেও কৃষিকাজের জন্য যে হিজরি সনকে অনুকরণ করে চলা কিছুটা কঠিন, এই ব্যাপারটা মোগল সম্রাট আকবর বেশ ভাল করেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আর তাই কৃষিকাজ এবং খাজনা আদায়ে সুবিধার্থে তিনি আলাদা একটা পঞ্জিকা প্রবর্তনের আদেশ করেন।এর আগে মোগল বাদশাহগণ রাজকাজে ও নথিপত্রে ব্যবহার করতেন হিজরী সন। আকবরের নির্দেশে তার নবরত্ন সভার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম প্রচলন করেন হিজরী ৯৬৩ সনে। অর্থাৎ ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ । তবে সিংহাসনে আরোহনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ সন থেকে। হিজরী চন্দ্র বছর, যা ন্যূনধিক ৩৫৪ দিনে পূর্ণ হয়। কিন্তু সৌর বছর পূর্ণ হয় ন্যূনধিক ৩৬৫ দিনে। বছরে প্রায় ১১ দিনের পার্থক্য হওয়ায় হিজরী সন প্রতি ৩৩ বছরের মাথয় সৌর বছরের তুলনায় এক বছর বৃদ্ধি পায়। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলী সন। পরে তা বঙ্গাব্দ বা ‘বাংলা বর্ষ’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে বৈশাখ নামটি নেয়া হয় নক্ষত্র বিশাখার নাম থেকে। মোটকথা, চন্দ্র সনকে সৌর সনে রূপান্তর করে বাংলা সনের প্রচলন করা হয়।

এই অর্থে বাংলা সন হিজরী সনের সন্তান। যার জন্ম মাত্র ৪৬২ বছর আগে। তাহলে তা হাজার বছরের ঐতিহ্য হয় কিভাবে?

মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্ম:



পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়, তার ইতিহাস মাত্র ২৭ বছর। ১৯৮৯ সালের আগে এরকম কিছু হতো না। ’আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান চালু করে চারুকলার কিছু ছাত্র। এর অন্যতম সংগঠক ছিলো শিল্পী তরুণ ঘোষ। পশ্চিম বাংলার বরোদায় আর্ট ইনিইটউটের ছাত্র ছিল সে। বরোদায় যেভাবে নতুন বছরকে বরণ করার জন্য নানা ফোক মোটিফ, মুখোশ ও খেলনার আয়োজন করে, সেই কনসেপ্ট আদমানী করে তরুণ ঘোষ এবার সাজায়। প্রথমে এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। সেবার কিছু মুখোশ আর জীবজন্তুর প্রতীক ছিলো। পরে এটাকে আরো হিন্দুয়ানী করে নাম বদলে দেয়া হলো ”মঙ্গল শোভাযাত্রা।” এখন সেখানে হিন্দুদের প্রায় দেবদেবী, গনেশের বিভিন্ন প্রতিমা, রাক্ষস-খোক্কস, অসুর, আবার রাজাকার প্রতিকৃতি/মুখোশ বহন করা হয়। তাহলে, এই মঙ্গল শোভাযাত্রা কি করে আবহমানকালের ঐহিত্য হয়? আসলে শেয়াল-কুকুর আর ভুত-পেত্নীর মুখোশ পরে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার এই ব্যর্থ চেষ্টা মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই নয়।

পান্তা ইলিশ :



আর পান্তা-ইলিশও বাংলাদেশে প্রথম চালু হয় ১৯৮৩ সালের বৈশাখের সময়। দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ, কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল সহ কিছু তরুণ সাংবাদিক কবি প্রথম পান্তা ইলিশের আয়োজন করে রমনার বটমুল। জনপ্রতি পঁচ টাকা চাঁদা দিয়ে পান্তা ভাত, ভর্তা আর ডিম দিয়ে খাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ডিম বদল করে দেযা হয় ইলিশ ভাজা। সেই থেকে চালু হয়ে গেলো পান্তা ইলিশ কালচার । এর আগে পান্তা ইলিশ দিয়ে বর্ষবরনের কথা শোনা যায়নি। বর্তমানে এই পান্তা-ইলিশ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি চলছে, যে মনে হয় এটা না খেলে বুঝি বর্ষবরন হবে না। এর চাপ পড়েছে মাছের বাজারে এবং নদীতে। ইলিশের হালি ৪০ হাজার টাকা গিয়ে ঠেকেছে, এমনকি দিনাজপুরে তিন মন ধানে এক কেজি ইলিশ! ঢাকা শহরের ধনীর দুলাল দুলালীরা ‘পান্তা-ইলিশ’ দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করতে যায়, যেখানে থালার রেট হাজার টাকাও ওপরে। অথচ প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে বাংলার সংস্কৃতি চর্চা নয়, সাধারণ গরীব মানুষদের উপহাস করা হচ্ছে!

সর্বজনীন নয়; হিন্দুজনীন:



ওরা বলছে, পহেলা বৈশাখ একটি সর্বজনিন বাঙালী উৎসব। ঐ দিনের সর্বজনীন উৎসবের মধ্যে রয়েছে: হিন্দুদের ঘটপুজা, গণেশ পুজা, সিদ্ধেশ্বরী পুজা, হিন্দুদের ঘোড়ামেলা, হিন্দুদের চৈত্রসংক্রান্তি পুজা-অর্চনা, হিন্দুদের চড়ক বা নীল পুজা বা শিবের উপাসনা ও সংশ্লিষ্ট মেলা, গম্ভীরা পুজা, কুমীরের পুজা, অগ্নিনৃত্য, ত্রিপুরাদের বৈশুখ মারমাদের সাংগ্রাই ও পানি উৎসব, চাকমাদের বিজু উৎসব (ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের পুজা উৎসবগুলোর সম্মিলিত নাম বৈসাবি), হিন্দু ও বৌদ্ধদের উল্কিপুজা, মজুসি তথা অগ্নি পূজকদের নওরোজ, হিন্দুদের বউমেলা, মঙ্গলযাত্রা এবং সুর্যপুজা।
একটু ভাবুন, ইসলাম সূর্যপুজারীদের সাথে সময়ের সামঞ্জস্য হয়ে যাবে বলে তিন সময় নামায পড়া হারাম করেছে। আর কাফেরদের পুজাকে এখন বানানো হচ্ছে সর্বজনীন!!!

বাঙ্গালী বনাম মুসলমান:



বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা ১৯৬৭ সাল থেকে এবং শোভাযাত্রার সূচনা ১৯৮৯ সাল থেকে। তাহলে এ আয়োজনকে কিভাবে বাঙালীর সংস্কৃতি দাবি করা হয়? আজ থেকে ১০০ বছর আগের বাঙালী কোন মা, বধু, কণ্যা কী স্বপ্ন দেখতেন যে, কোন পর পুরুষ তার শরীরের লোভনীয় অঙ্গে আলপনা এঁকে দিবে, সে কোন পর পুরুষকে মুখে তোলে ইলিশ-পান্তা খাওয়াবে? বিগত হাজার বছরের বাঙালী নারী সমাজ পরপুরুষের সান্নিধ্যকে ঘৃণা করে এসেছে। বাঙালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য হচ্ছে পর্দা ও শালীনতা বোধের গর্বিত ইতিহাস। ছেলে-মেয়ে এক সাথ বটতলায় বসা বাঙালীর সংস্কৃতি নয়। হ্যাঁ, শরৎ চন্দ্রের ভাষায় ভাষা মিলিয়ে কেউ যদি বলেন, ‘আজ বিকেলে বাঙালী বনাম মুসলমান ছেলেদের মাঝে ফুটবল খেলা হবে’ তবে তিনি বর্ষবরণের প্রচলিত আয়োজনগুলোকে বলতে পারেন বাঙালী সংস্কৃতি।



কিন্তু একজন মুসলমান কখনো বর্ষবরণের এ আয়োজনগুলোকে “আমাদের সংস্কৃতি” বলতে পারে না। আমরা ভাষায় বাঙালী, এ কথা সত্য। এর চেয়েও বড় সত্য কথা হচ্ছে, বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে আমরা মুসলমান। আমাদের সব চেয়ে বড় পরিচয় আমরা মুসলমান। আমাদের সব কিছুই অন্যদের থেকে আলাদা। জন্ম থেকে নিয়ে বিবাহ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সকল কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ, রীতি-রেওয়াজ ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত। ধর্ম ভেদে সংস্কৃতি ভিন্ন হবেই। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الإسلام دِيناً فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“যে ব্যক্তি ইসলামের বাইরে যেয়ে অন্য কিছুর চর্চা করবে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না।” (আলে ইমরান ৩:৮৫) তাই সকল ধর্মের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য সর্বজনীন সংস্কৃতি বলতে উদ্ভট কোন কিছুর অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে নেই।

আকবর ও তার পরবর্তীযুগে পহেলা বৈশাখ:



আকবারের সময় থেকেই বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির সেই মালিকেরা তাদের কৃষকদের মিষ্টিমুখ করাতেন।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। হালখাতা মানে হিসাব রক্ষণের পুরাতন বই হালনাগাদ করে নতুন বই খোলা। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন।

পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে পুরনাঙ্গ ধারনা পেতে চাইলে প্রথমেই যেই ব্যাপারটা আপনাকে একদম ভুলে যেতে হবে সেটা হল – পহেলা বৈশাখ উদযাপন হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি। বাংলা সন প্রচলন হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে, আজকে থেকে ৪৩৪ বছর আগে। যদি আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকেই হিসাব করা হয় তাহলেও সেটা মাত্র (১৫৫৬-২০১৮) ৪৬২ বছরের পুরনো হয়। একেবারে সহজ করে বলতে গেলে, পহেলা বৈশাখ উদযাপন হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি তো ঠিক, তবে সেটা প্রায় ৬০০ বছর কম হাজার বছরের সংস্কৃতি।

এবার চলুন এই ৬০০ বছর টাকেও আরও বাড়িয়ে দেয়া যাক!
“আধুনিক পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে ওই বছর পহেলা বৈশাখে ‘হোম কীর্তন’ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।” (প্রথম মহাযুদ্ধে বাংলা বর্ষবরণ, মুহাম্মদ লুৎফুর হক দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৮)
১৯১৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত অতিক্রান্ত বছর ১০১; হাজার নয়।

ছায়ানট ও পহেলা বৈশাখ:



এখন কিছু ‘হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি’র সাথেও পরিচিত হই। ছায়ানট আর রমনাবটমূল দিয়েই শুরু করি:
পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানটাই হল ছায়ানটের শিল্পীদের গান দিয়ে বর্ষকে বরণ করে নেয়া। তবে গানের মাধ্যমে বৈশাখ বরনের এই চল ছায়ানট কবে থেকে শুরুকরল সেই ব্যাপারে দুটো মত পাওয়া যায়ঃ

একটি মত হলো, ১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫) ছায়াানট প্রথম এ উৎসব শুরু করে। অন্য একটি মতে, ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। এই দুটো মতের মধ্যে দ্বিতীয় ম মতটা অধিক গ্রহণযোগ্য। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের তীব্র অভিপ্রায়ে কিছু রবীন্দ্র ভক্তের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠত হয় ছায়ানট। ছায়ানটের জন্মই যেখানে ৫৭ বছর আগে, সেখানে গানের মাধ্যমে রমনাবটমূলে বর্ষবরণ করাকে হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়া প্রথম শ্রেণির একটা কৌতুক।

পহেলা বৈশাখ না কি রবীন্দ্র বন্দনা:



সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনেও পহেলা বৈশাখ এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তৎকালীন আইয়ুব সরকারের আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতার প্রতিবাদস্বরূপই বৈশাখের প্রথম দিনে ছায়ানট রমনার বটমূলে নববর্ষ পালনের আয়োজন করে। পরে ক্রমশই এ অনুষ্ঠান বিপুল জনসমর্থন লাভ করে এবং স্বাধীকার আন্দোলনের চেতনায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নীতির বিরুদ্ধে ও বাঙালি আদর্শের লালনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় বাংলা নববর্ষ পালিত হতে থাকে।” অর্থাৎ, পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপনের ব্যাপারটাকে টেনে-টুনে বড়জোর ৬০’এর দশকে নেয়া যায় । তবে এর সঙ্গে আকবরের প্রবর্তিত বাংলা সনের সম্পর্ক যতটাই একবারে নেই ঠিক ততটাই আছে রবীন্দ্রনাথের সাথে, রবীন্দ্রবন্দনার সাথে।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন/দস্যুপনা:



আবহমানকাল ধরে একটি দেশের মানুষের রুচি, সামাজিক কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও বিশ্বাস নিয়ে গড়ে ওঠা রীতিনীতিই হলো দেশীয়, লোকজ সংস্কৃতি। এতে মূলত ধর্মীয় বিধি-নিষেধেরই প্রতিফলন ঘটে থাকে। এ দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের জীবনধারা ইসলামের অনুসারী হওয়ায় ইসলামই হচ্ছে এদের লোকজ সংস্কৃতির প্রাণশক্তি।
এ জন্য প্রকৃত দেশজ সংস্কৃতির সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই। কারণ, তা মূলত ইসলামী সংস্কৃতি। যেমন, আজান, নামায, ঈদ, কুরবানী ইত্যাদি। কিন্তু ‘দেশজ সংস্কৃতির নামে যখন অন্য একটি পৌত্তলিক ধর্মের পুজা-পার্বন ও সংস্কৃতির অনুসরণ ও মিশ্রণের অপচেষ্টা করা হয়, তখন তা প্রতিহত করা অনিবার্য হয়ে যায়। অন্যথায়, জাতীয় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। হাজার বছরের সংস্কৃতির সাথে কিছু প্রাণী মূর্তির মঙ্গলযাত্রা যোগ করলেই তা দেশজ সংস্কৃতি হয়ে যায় না। বরং তা হচেছ মূলত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।

একটি সুস্থ সংস্কৃতির ভেতরে কৌশলে অন্যধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ঐ ধর্মের দেউলিপনাকেই প্রমাণ করা। এটা সাংস্কৃতির দস্যুপনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর দ্বারা কিভাবে আমাদের কোমলমতি শিশু ও আগামী প্রজন্ম মুশরিক হয়ে যাচ্ছে, তার একটি নমুনা দেখুন। একটি পত্রিকা ছেপেছে, “পয়লা বৈশাখের কদিন আগেই ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলপড়–য়া অনি তার মায়ের সঙ্গে চারুকলা ঘুরে গেছে। একটা লক্ষীসরাও কিনেছে। মায়ের কাছে গল্প শুনে শুনে তখনই সে মাকে বলেছে, এবারই নতুন পোশাক পরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেবে। অনিকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন সে এই শোভাযাত্রায় অংশ নেবে? ছোট্ট অনি বলেছে, ‘এটা এক ধরনের প্রার্থনা। মা বলেছে, এই শোভাযাত্রায় অংশ নিলে ভালো হবে।’

ইসলামের আলো আজ বড় প্রয়োজনঃ



প্রিয় অভিভাবক! আপনার স্নেহের সন্তানকে যে বয়সে আপনি রশি ছেড়ে রেখেছেন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করতে, সে বয়সে মুস‘আব বিন উমাইর [রা.] গিয়েছেন ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হতে। আপনার সচেতনতার অভাবে যদি আপনার সন্তান নষ্ট হয় তবে আপনি ব্যর্থ অভিভাবক। জেনে রাখুন! রাসূল [সা.] বলেছেন, اَلاَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৮৫] সুতরাং আসুন! সেদিন আসার আগেই আমরা সচেতন হই, যেদিন আমার সন্তান আমার জান্নাতের গতিরোধ করবে।

বাংলাদেশের জনগন মূলত দু’টি বড় ধর্মের (মুসলমান ও হিন্দু) অনুসারী। শান্তিপূর্নভাবে যার যার ধর্মচর্চা এ দেশের ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু বর্তমানে কিছু আদর্শচ্যুত নামধারী মুসলমান হিন্দু ধর্মের কিছু পার্বনকে “সার্বজনীন উৎসব” হিসাবে প্রচার করতে শুরু করেছে উদ্দেশ্য মূলকভাবে। এ দেশের একটি গোষ্ঠী বাঙ্গালী হ’তে গিয়ে হিন্দু রীতির লৌহ নিগঢ়ে নিজেকে জড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক হ’তে চাইছেন। দুর্ভাগ্য হতভাগা মুসলমানদের, যারা নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে হিন্দু সংস্কৃতির ধারক-বাহক সেজেছে। তবে বাংলাদেশের ১৫ কোটি বাঙ্গালী মুসলমান দুর্গাপুজা বা গণেশপুজার উৎসবকে বাঙ্গালী সংস্কৃতি মনে করে না, এটাই সত্য। তাই আদর্শহীনেরা আমাদেরকে তা গিলাতে চেষ্টা করছে।

সচেতন মুমিনদের উচিত বর্ষবরণের মতো এমন বেলেল্লাপূর্ণ এবং অর্থ ও সময়ের অপচয়সর্বস্ব অনুষ্ঠান হতে বিরত থাকা এবং সর্বস্তরের মুসলমানদের এই অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষায় বিগত বছরের কর্মকান্ড মূল্যায়ন করে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আগামী দিনের জন্য সুপাথেয় সংগ্রহের জন্য উদ্যমী হওয়া। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!

পঠিত : ১০২৬ বার

মন্তব্য: ০