Alapon

দেশজ সংস্কৃতিতে উদ্ভাসিত হউক বাংলা নববর্ষ

আলাপন ব্লগের সকল সুপ্রিয় পাঠক ও ব্লগারদের জানাচ্ছি বাংলা নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আশা করছি ১৪২৫ বঙ্গাব্দ সকল বাঙ্গালীর জীবনে শান্তির সুবাতাসের সঙ্গে বয়ে আনবে নির্মল আনন্দঘন মুহূর্ত। 
 
প্রত্যেক জাতির পরিচয় লুকিয়ে থাকে তার সংস্কৃতির মধ্যে। তাই বিশেষজ্ঞগণ বলে থাকেন, সংস্কৃতি জাতিসত্তা বিকাশের অবিচ্ছেদ অংশ। প্রত্যেক দেশের সংস্কৃতি তার চৌ-সীমানায় বসবাসরত অধিবাসীর সুস্থ ও সচেতন মানস গঠনে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে থাকে। নিজ সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট প্রতিফলন। নিজ সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রত্যেক ব্যক্তিকে জীবনের প্রাথমিক দীক্ষা দেয়। 

সমগ্র পৃথিবীতে বাংলা ভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। বাঙ্গালী জাতি একটি ভাষা ভিত্তিক জাতি। যাদের জন্ম বঙ্গে, মাতৃভাষা বাংলা তারাই মূলত বাঙ্গালী। বাঙ্গালী জাতি আবহমান কাল থেকে নিজ সংস্কৃতি লালন করে আসছে। বাঙ্গালী জাতির সংস্কৃতির প্রাণশক্তি খুবই মজবুত ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। এই সংস্কৃতি বঙ্গের অধিবাসি তথা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের একই গাছের ছায়াতলে ধরে রেখেছে দীর্ঘদিন। ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও অভিন্ন মূল্যবোধ, জাতীয় চেতনা সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে রূপ দিয়েছে সম্বনিত ও সুস্থিত কাঠামোতে। তাই বাঙ্গালী জাতিকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোন ভিনদেশী সংস্কৃতিতে দীক্ষা নেওয়ার নূন্যতম প্রয়োজন নেই। 

৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি এদেশের সংস্কৃতি ধারণ ও বহন করে চলছে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে সাম্রাজ্যবাদীদের বিষাক্ত চোখের ইশারায় পরিচালিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের নির্মল সংস্কৃতি বিলুপ্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কথায় আছে কোন জাতি কে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে দাও। আজ তারা এই নীতি কৌশল গ্রহণ করেছে। তাই তারা এদেশের গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক) গুলোতে বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশন শো, সঙ্গীত-অভিনয় প্রতিযোগিতা, সুন্দরী প্রতিযোগীতা, চলচিত্র-নাটক, বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন ম্যাগাজিন, সাহিত্য সহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গড়ে তুলেছে অপসংস্কৃতির ঘৃণ্য জাল। এর পাশাপাশি সোস্যাল মিডিয়া  ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি অপব্যবহারের দ্বার উন্মেচন করেছে। ফলশ্রুতিতে এদেশের তরুণ ও যুব সমাজ তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ভুলে যাচ্ছে নিজ সংস্কৃতি, সাথে সাথে অপসংস্কৃতির চক্রাকারে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে সজীব প্রাণশক্তি গুলো। 

এই ভয়াবহ অদৃশ্য হামলা আমাদের সমাজকে করে তুলছে অস্থিশীল। প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে খুন, ধর্ষন, আত্মহত্যা, বিকৃত যৌনাচার, মাদকাশক্তির ভয়াল গ্রাস তছনছ করে দিচ্ছে সুস্থ জীবন। পশ্চিমা সংস্কৃতি গ্রহণ করে এদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ,অনাচার যৌন পাপাচার। যা সত্যিই আতঁকে উঠার মতো স্পর্শকাতর ঘটনা ষংঘটিত হচ্ছে আমাদের চারপাশে। এখন বাতাসে অক্সিজেন পাওয়া যায়না, সেখানে শুধু কার্বন মনোঅক্সাইডের বিষাক্ত কণা ঘুরঘুর করছে। 

সাংস্কৃতিক দিক থেকে শক্তিশালী প্রতিটি দেশ তাদের প্রধান প্রধান উৎসব সমূহ নিজ সংস্কৃতির আলোকে বাস্তবায়ন করে। কিন্তু আমাদের মতো হাজার বছরের পলি মাটি বিধৌত বঙ্গ তথা বাংলাদেশের সুপ্রাচীন জনপদকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গিলে খেতে চাচ্ছে। তাই এই দেশের প্রধান প্রধান উৎসব গুলোতে তারা উড়িয়ে দিয়েছে বিষাক্ত গ্যাস বেলুন। তাইতো যেকোন উৎসব তা হউক স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস কিংবা বাংলা নববর্ষ সবদিন কে তারা তরুণ-তরুণীদের কাছে উপস্থাপন করছে ভালোবাসা দিবসের মিথ্যা মোড়কে। 

অতীতে বাংলা নববর্ষ ছিল মূলত ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। সম্রাট আকবর হিজরী ৯৬৩ সনের সাথে মিল রেখে বাংলা নববর্ষ প্রত্যাবর্তন করেন। ইরানের নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান “নওরোজ” এর আদলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের নির্দেশ দেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় জাঁকজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ পালিত হতো। মূলত সম্রাট আকবরের শাসনকালে বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের খাজনার টাকা পরিশোধ করতে পারত। পরের দিন অথাৎ পহেলা বৈশাখের দিন ভূ-স্বামীরা কৃষকদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে সেসময় মেলা ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো। পরবর্তীতে তা ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও সার্বজনীন উৎসবমুখী হয়ে উঠে। 
 
অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে বাংলা নববর্ষ শুরু হলেও তা সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে ওতপ্রোতভাবে। এই দিনটির জন্য গ্রামের লোকজন সারা বছর অপেক্ষা করে। নববর্ষের দিন তারা বাড়ীঘর পরিস্কার, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে সকাল সকাল তারা ঘরের কাজ সমাপ্ত করে। অতঃপর নতুন ফসল দ্বারা বিভিন্ন ধরনের খাবারের আয়োজন, পিঠা-পুলি তৈরী করে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রন করে। নববর্ষের দিন চলে সবস্তরের মানুষের মাঝে শুভেচ্ছা ও প্রীতি বিনিময়। একে অপরকে উপহার দেওয়া ঐতিহ্যের অংশ।

নববর্ষের প্রধান আকর্ষণ বৈশাখী মেলা। গ্রামের বড় মাঠে মেলা বসে। মেলাতে কৃষিজ পণ্য, কুটির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্পের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খেলনা, বিভিন্ন ধরনের দেশী খাদ্যদ্রব্য (যেমন-চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, মিষ্টি), মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী ইত্যাদী ক্রয়-বিক্রয়ের ধূম পড়ে যেত। অতীতে মেলাতে ষাড়েঁর লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠি খেলা, বলি খেলা চলত। মেলাগুলোতে যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গান সহ বিভিন্ন ধরনের লোক সঙ্গীত, বাউল-মারফতি, মুর্শিদি-ভাটিয়ালি, গজল ইত্যাদি আঞ্চলিক গান পরিবেশিত হতো। শিশুদের জন্য সার্কাস, নাগরদোলা, পুতুলনাচ ইত্যাদি ছিল বিশেষ আকর্ষণ।

কালের বিবর্তনে নববর্ষের অনেক ঐতিহ্যের সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু গ্রামগঞ্জে সামান্য পরিমানে সংস্কৃতি সংরক্ষন করা গেলেও, বড় বড় শহরে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমাদের দেশী সংস্কৃতি হটিয়ে সেখানে আজ স্থান করে নিয়েছে ভিন দেশী সংস্কৃতি। অপসংস্কৃতির সয়লাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। নববর্ষকে কেন্দ্র করে এখন আর দেশজ গান-বাজনা হয়না বললেই চলে। পুতুলনাচ, মোরগের লড়াই, ষাড়ের লড়াই আজ জাদুঘরের চার দেয়ালে বন্দি। তরুণ সমাজের আচার-আচারণ, পোষাক-পরিচ্ছেদ দেখলে বোঝা যায় তারা দেশকে নয় ভিনদেশকে উপস্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। বিদেশী আবহাওয়াকে ধারণ করে তারা বাংলা নববর্ষের দিন মেতে উঠে হিন্দি/ইংরেজি ডিসকো নাচ গানে, দেশীয় নাটক-নাটিকার স্থান নিয়েছে ভিন দেশী অশ্লীল চলচিত্র। ফলশ্রুতিতে বাঙ্গালী জাতির আকাঙ্খিত দিন আজ পর্যবেশিত হচ্ছে ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, মাদক গ্রহনের উৎসবের মধ্য দিয়ে। যা আমাদের অতীতের সকল সংস্কৃতিকে ঘুনে পোকার মতো ধ্বংস করে দিচ্ছে। 

বাংলা নববর্ষের সঙ্গে বাঙ্গালী সংস্কৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সচেতন জাতি প্রত্যাশা করে এদেশের তরুণ সমাজ তাদের অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে গিয়ে নিজ শেকড়ের সন্ধান করবে। নিজেদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক বাহক রূপে গড়ে তুলবে। মানুষে মানুষে গড়ে তুলবে ভালবাসার সৌহার্দের বন্ধন। অপসংস্কৃতির শত শত মিসাইল, এটমবোমা প্রতিরোধে আমাদের জাতিয় সংস্কৃতির চেতনাকে আরোবেশী করে চর্চা ও সমৃদ্ধ করতে হবে। অপসংস্কৃতির প্রবেশ যেকোন মূল্যে রুখে দিতে হবে। তরুণ সমাজকে নিজস্ব সংস্কৃতি ধারন করে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে পারস্পারিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। 

একটি কথা দিয়ে শেষ করছি, সংস্কৃতি বেঁচে থাকলে, বাঁচবে দেশ, বেঁচে থাকবে বাংলাদেশ! 
 

পঠিত : ৯১৫ বার

মন্তব্য: ০