Alapon

উমার রাঃ এর শাসনামলে খালিদের জয়যাত্রা

৬৩৪ সালের ২২ আগস্ট আবু বকর ইন্তেকাল করেন। তিনি উমরকে নিজের উত্তরসূরি নিয়োগ দিয়ে গিয়েছিলেন। খলিফা হওয়ার পর উমর খালিদকে পদচ্যুত করে আবু উবাইদাকে সেনাপতি নিয়োগ করেন। খালিদ অপরাজেয় হওয়ায় অনেক মুসলিম তার কারণে যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হচ্ছে বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। 

এই ব্যাপারে উমর বলেছিলেন :"আমি খালিদ বিন ওয়ালিদকে আমার ক্রোধ বা তার দায়িত্বহীনতার কারণে অব্যাহতি দিই নি, এর কারণ ছিল আমি লোকদের জানাতে চাইছিলাম যে বিজয় আল্লাহর তরফ থেকে আসে।" 

খালিদ খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে নির্দেশ অনুযায়ী আবু উবাইদার অধীনে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি বলেছিলেন : "যদি আবু বকর ইন্তেকাল করেন আর উমর খলিফা হন, তবে আমরা শুনব এবং মানব" আবু উবাইদার নেতৃত্বে এরপর সিরিয়া অভিযান চলতে থাকে। আবু উবাইদা খালিদের গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি খালিদকে অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং নিজের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন।


খুলাফায়ে রাশেদার সময়ে ইসলামী রাষ্ট্রের বিস্তৃতি

মধ্য লেভান্ট বিজয়
আবু উবাইদা প্রধান কমান্ডার নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি আবু-আল-কুদসে অনুষ্ঠিত বার্ষিক মেলায় একটি ছোট সেনাদল পাঠান। বাইজেন্টাইন ও খ্রিষ্টান আরব গেরিসন এই মেলা পাহারা দিচ্ছিল। গেরিসনের সৈনিকরা দ্রুত মুসলিমদের ঘিরে ফেলে। সেনাদলটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পূর্বে আবু উবাইদা গোয়েন্দা মারফত খবর পান এবং তাদের উদ্ধার করার জন্য খালিদকে প্রেরণ করেন। ৬৩৪ সালের ১৫ অক্টোবর সংঘটিত আবু-আল-কুদসের যুদ্ধে খালিদ তাদের পরাজিত করেন। উক্ত মেলা থেকে প্রচুর সম্পদ অর্জিত হয় এবং অনেক রোমান বন্দী হয়।

মধ্য সিরিয়া অধিকারের মাধ্যমে মুসলিমরা বাইজেন্টাইনদের উপর প্রবল প্রভাব সৃষ্টি করে। উত্তর সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের মধ্যে যোগাযোগ এসময় বন্ধ হয়ে যায়। আবু উবাইদা ফাহলের দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন। এখানে একটি শক্তিশালী বাইজেন্টাইন গেরিসন ও আজনাদয়ানের যুদ্ধে রক্ষা পাওয়ারা আশ্রয় নিয়েছিল। বাইজেন্টাইনরা এখান থেকে পূর্ব দিকে আক্রমণ করতে পারত এবং এর ফলে আরব থেকে সহায়তা বন্ধ হয়ে যেত বলে এই অঞ্চল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়াও পেছনে বৃহৎ গেরিসন থাকায় ফিলিস্তিনে অভিযান চালানো সম্ভব ছিল না। মুসলিম বাহিনী ফাহলের দিকে যাত্রা করে। খালিদ এই বাহিনীর অগ্রবর্তী দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৬৩৫ সালের ২৩ জানুয়ারি সংঘটিত ফাহলের যুদ্ধে বাইজেন্টাইন বাহিনী পরাজিত হয়।


খালিদ বিন ওয়ালিদের সিরিয়া অভিযানের চিত্র  

এমেসার যুদ্ধ এবং দামেস্কের দ্বিতীয় যুদ্ধ
ফাহলের বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। আমর ইবনুল আস ও শুরাহবিল ইবনে হাসানা ফিলিস্তিন জয়ের জন্য দক্ষিণে এবং আবু উবাইদা ও খালিদ উত্তর সিরিয়া জয়ের জন্য উত্তরদিকে যাত্রা করেন। মুসলিমরা ফাহলে ব্যস্ত থাকাকালীন সময়ে সম্রাট হেরাক্লিয়াস সুযোগ লাভ করেন। দামেস্ক পুনরাধিকারের জন্য তিনি দ্রুত সেনাপতি থিওডরের অধীনে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। হেরাক্লিয়াসের এই নতুন বাহিনী প্রেরণের পর মুসলিমরা ফাহল থেকে এমেসার দিকে যাত্রা করছিল। এমেসার দিকে অর্ধেক যাত্রা করার পর মুসলিম ও বাইজেন্টাইন বাহিনী মারাজ-আল-রোমে মুখোমুখি হয়। সেনাপতি থিওডর রাতের বেলা বাহিনীর অর্ধেককে দামেস্কের মুসলিম গেরিসনে অতর্কিত আক্রমণের জন্য পাঠান। খালিদের গোয়েন্দারা তাকে এই খবর জানায়। 

আবু উবাইদার অনুমতিক্রমে তিনি ভ্রাম্যমাণ গার্ডদের নিয়ে দামেস্কের দিকে রওয়ানা হন। মারাজ-আল-রোমের যুদ্ধে আবু উবাইদা রোমানদের সাথে লড়াই করার সময় খালিদ দামেস্কের দিকে যাত্রা করেন এবং দামেস্কের দ্বিতীয় যুদ্ধে সেনাপতি থিওডরাসকে পরাজিত করেন। একসপ্তাহ পর আবু উবাইদা বালবিক জয় করেন। এখানে জুপিটারের মন্দির অবস্থিত ছিল। এরপর তিনি খালিদকে এমেসার দিকে পাঠান।

এমেসা ও চেলসিসের তরফ থেকে এক বছরের শান্তির আবেদন করা হয়। আবু উবাইদা এই আবেদন গ্রহণ করে অন্যান্য বিজিত অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠা করায় মনোযোগী হন। তিনি হামা, মারাত আন নুমান জয় করেন। হেরাক্লিয়াসের নির্দেশনায় সম্পাদিত শান্তিচুক্তিগুলির কারণ ছিল যাতে উত্তর সিরিয়ার প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাওয়া যায়। এন্টিওকে বাহিনী গঠন করার পর হেরাক্লিয়াস তাদেরকে উত্তর সিরিয়ার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাঠান, বিশেষত চেলসিসের দুর্গে। শহরে বাইজেন্টাইন বাহিনীর আগমনের ফলে শান্তিচুক্তি লঙ্ঘিত হয়। এরপর আবু উবাইদা ও খালিদ এমেসার দিকে যাত্রা করেন। খালিদের অগ্রবর্তী দলের মুখোমুখি হওয়া বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করা হয়। মুসলিমরা এমেসা অবরোধ করে। দুই মাস অবরোধের পর ৬৩৬ সালের মার্চে এমেসা আত্মসমর্পণ করে।

ইয়ারমুকের যুদ্ধ
এমেসা অধিকার করার পর মুসলিমরা উত্তর সিরিয়া অধিকারের জন্য যাত্রা করে। ইতিমধ্যে, হেরাক্লিয়াস এন্টিওকে একটি বৃহদাকার সেনাদল গঠন করেছিলেন। উত্তর সিরিয়ার রোমান বন্দীদের কাছ থেকে খালিদ এই খবর পান। পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে হেরাক্লিয়াস মুসলিমদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত লড়াইয়ে নামতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি মুসলিম সেনাদলগুলিকে পরস্পর থেকে পৃথক করে ফেলে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। ৬৩৬ সালের জুনে পুনরাধিকারের জন্য পাঁচটি বৃহদাকার সেনাদল বিভিন্ন দিক থেকে সিরিয়ার দিকে প্রেরণ করা হয়। 


ইয়ারমুকের যুদ্ধের পূর্বে মুসলিম ও বাইজেন্টাইন সৈনিকদের চলাচলের পথ।

খালিদ হেরাক্লিয়াসের পরিকল্পনা আন্দাজ করতে পারেন। যুদ্ধসভায় তিনি আবু উবাইদাকে সব মুসলিম সেনাদল এক স্থানে জমায়েত করার প্রস্তাব দেন যাতে বাইজেন্টাইনদের সাথে চূড়ান্তভাবে লড়াই করা সম্ভব হয়। খালিদের পরামর্শক্রমে আবু উবাইদা সিরিয়ার সকল মুসলিম সেনাদলকে বিজিত অঞ্চল ত্যাগ করে জাবিয়ায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেন। এর ফলে হেরাক্লিয়াসের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তিনি মুসলিমদের সাথে খোলা ময়দানে যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না কারণ এর ফলে মুসলিমদের হালকা অশ্বারোহী বাহিনী বাইজেন্টাইনদের ভারি এবং কম দ্রুততাসম্পন্ন অশ্বারোহী বাহিনীর উপর আধিপত্য স্থাপন করার সম্ভাবনা ছিল। 

খালিদের পরামর্শ অনুযায়ী আবু উবাইদা মুসলিম বাহিনীকে জাবিয়া থেকে ইয়ারমুক নদীর সমতল ভূমিতে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেন। এই স্থান পশুখাদ্য ও পানির সরবরাহ ভালো ছিল এবং এখানে অশ্বারোহীদেরকে অধিক কার্যকারিতার সাথে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল। যুদ্ধসভায় আবু উবাইদা মুসলিম বাহিনীর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব খালিদের হাতে তুলে দেন। খালিদ যুদ্ধের মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন এবং বাইজেন্টাইনদের পরাজিত করায় মূল পরিকল্পনাকারীর ভূমিকা রাখেন।

১৫ আগস্ট ইয়ারমুকের যুদ্ধ শুরু হয় এবং ছয়দিন ধরে চলে। যুদ্ধে বাইজেন্টাইন পক্ষ পরাজিত হয়। ইয়ারমুকের যুদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম ফলাফল নির্ধারণকারী যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত। পরাজয়ের মাত্রার কারণে বাইজেন্টাইনদের বিপর্যয় সামলে উঠতে সময় লেগেছিল। তখন পর্যন্ত সিরিয়ায় সংঘটিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই যুদ্ধে বিজয় ছিল মূলত খালিদ বিন ওয়ালিদের কৌশলগত নৈপুণ্য।

জেরুজালেম জয়
যুদ্ধে বাইজেন্টাইনরা পরাজিত ও বিক্ষিপ্ত হওয়ার পর মুসলিমরা দ্রুত ইয়ারমুকের পূর্বে বিজিত এলাকা পুনরায় অধিকার করে নেয়। এরপর মুসলিমরা দক্ষিণ দিকে বাইজেন্টাইনদের শেষ শক্তঘাটি জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হয়। ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশ নেয়া অনেক বাইজেন্টাইন সদস্য এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। জেরুজালেমের অবরোধ চার মাস স্থায়ী হয়। এরপর খলিফা উমরকে আসতে হবে এই শর্তে জেরুজালেম আত্মসমর্পণ করে। 

জেরুজালেমের আত্মসমর্পণের পর মুসলিম বাহিনীকে পুনরায় কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ানের সেনাদল দামেস্ক আসে এবং বৈরুত অধিকার করে। আমর ইবনুল আস ও শুরাহবিল ইবনে হাসানার সেনাদল ফিলিস্তিনের বাকি অঞ্চল অধিকারের জন্য অগ্রসর হয়। আবু উবাইদা ও খালিদের ১৭,০০০ সৈনিকের সেনাদল সমগ্র উত্তর সিরিয়া অধিকারের জন্য অগ্রসর হয়।

উত্তর সিরিয়া জয়
এমেসা ইতিমধ্যে হস্তগত হয়েছিল। আবু উবাইদা ও খালিদ চেলসিসের দিকে যাত্রা করেন। কৌশলগত কারণে এটি বাইজেন্টাইনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ ছিল। এখান থেকে তারা আনাতোলিয়া, আর্মেনিয়া ও এন্টিওককে রক্ষা করতে সক্ষম ছিল। আবু উবাইদা খালিদকে সম্পূর্ণ মোবাইল গার্ড বাহিনী প্রদান করে চেলসিসের দিকে প্রেরণ করেন। কমান্ডার মেনাসের অধীনে গ্রীক সৈনিকরা এটি প্রহরা দিচ্ছিল। 

বলা হয় যে মেনাস সম্রাটের পর দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বাইজেন্টাইনদের প্রথামাফিক কৌশল বাদ দিয়ে খালিদের মুখোমুখি হওয়ার এবং মুসলিমদের মূল বাহিনী এসে পৌছার পূর্বে অগ্রবর্তী দলকে ধ্বংস করার সিদ্ধন্ত নেন। চেলসিস থেকে ৫কিমি পূর্বে অবস্থিত হাজিরে সংঘটিত হাজিরের যুদ্ধে রোমানরা পরাজিত হয়। এই বিজয়ের পর উমর খালিদের সামরিক কৃতিত্বের প্রশংসা করেছিলেন। উমর নিম্নোক্ত কথা বলেছিলেন বলে জানা যায়: "খালিদ সত্যিকার সেনাপতি, আল্লাহ আবু বকরের উপর রহমত করুক। তিনি মানুষকে আমার চেয়েও উত্তমরূপে চিনতে পারতেন।"


মানচিত্রে প্রদর্শিত খালিদ বিন ওয়ালিদের উত্তর সিরিয়া অভিযানের পথ।

আবু উবাইদা শীঘ্রই চেলসিসে খালিদের সাথে যোগ দেন। ৬৩৭ সালের জুন মাসে চেলসিস আত্মসমর্পণ করে। এই বিজয়ের ফলে চেলসিসের উত্তরের অঞ্চল মুসলিমদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এরপর খালিদ ও আবু উবাইদা অক্টোবরে আলেপ্পো অধিকার করেন। এরপরের লক্ষ্যবস্তু ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এশীয় অঞ্চলের রাজধানী এন্টিওক। এন্টিওকের দিকে যাত্রা করার পূর্বে খালিদ ও আবু উবাইদা শহরটিকে আনাতোলিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। 

এই উদ্দেশ্যে এন্টিওককে কৌশলগত প্রতিরক্ষা প্রদানকারী সকল দুর্গকে দখল করা হয়। এর মধ্যে এন্টিওকের উত্তরপূর্বের আজাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অরন্টেস নদীর নিকটে বাইজেন্টাইন বাহিনীর সাথে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ লোহা সেতুর যুদ্ধ নামে পরিচিত বাইজেন্টাইনরা পরাজিত হওয়ার পর এন্টিওকে আশ্রয় নিলে মুসলিমরা শহর অবরোধ করে। সম্রাটের দিক থেকে সাহায্যের আশা ক্ষীণ হওয়ায় সকল বাইজেন্টাইন সৈনিককে নিরাপদে কনস্টান্টিনোপল যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে এই শর্তে ৬৩৭ সালের ৩০ মার্চ এন্টিওক আত্মসমর্পণ করে।

আবু উবাইদা খালিদকে উত্তরদিকে পাঠান এবং নিজে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করে লাজকিয়া, জাবলা, তারতুস ও লেবানন পর্বতমালার বিপরীতের উপকূল জয় করে। খালিদ উত্তরদিকে অগ্রসর হয়ে আনাতোলিয়ার কিজিল নদীর অববাহিকায় অভিযান চালান। মুসলিমদের আগমনের পূর্বে সম্রাট হেরাক্লিয়াস এন্টিওক ত্যাগ করে এডেসা চলে গিয়েছিলেন। তিনি আল-জাজিরা ও আর্মেনিয়ায় প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে রাজধানী কনস্টান্টিনোপল রওয়ানা হন। এসময় তিনি অল্পের জন্য খালিদের মুখোমুখি হওয়া থেকে বেঁচে যান। খালিদ এসময় মারাশ অধিকার করার পর দক্ষিণে মুনবিজের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। 

হেরাক্লিয়াস বলেছিলেন:
বিদায়, দীর্ঘ বিদায় সিরিয়া, আমার চমৎকার দেশ। তুমি এখন শত্রুদের হাতে। তুমি শান্তিতে থাকো, হে সিরিয়া - শত্রুদের জন্য তুমি কত সুন্দর ভূমি। 
— সম্রাট হেরাক্লিয়াস

ইয়ারমুকে বাইজেন্টাইনদের শোচনীয় পরাজয়ের ফলে সাম্রাজ্য দৃঢ়ভাবে মুসলিমদের করায়ত্ত হয়। সামরিক সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে হেরাক্লিয়াসের পক্ষে সিরিয়া ফিরে পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালানো সম্ভব ছিল না। হেরাক্লিয়াস জাজিরার খ্রিষ্টান আরবদের নিকট সহায়তা চান। তারা একটি বৃহৎ সেনাদল গঠন করে এবং আবু উবাইদার সদরদপ্তর এমেসার দিকে যাত্রা করে। আবু উবাইদা সমগ্র উত্তর সিরিয়া থেকে তার সেনাদের এমেসায় ফিরিয়ে আনেন এবং খ্রিষ্টান আরবরা এমেসা অবরোধ করে। 

খালিদ দুর্গের বাইরে উন্মুক্ত ময়দানে যুদ্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আবু উবাইদা এই বিষয়ে খলিফা উমরের কাছে বার্তা পাঠান। খলিফা উমর বিষয়টি দক্ষতার সাথে নিষ্পত্তি করেন। তিনি তিনটি ভিন্ন দিক থেকে ইরাকের মুসলিম বাহিনীকে প্রতিপক্ষ খ্রিষ্টান আরবদের আবাসভূমি জাজিরা আক্রমণের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি কাকা ইবনে আমরের নেতৃত্বে ইরাক থেকে আরেকটি সেনাদল এমেসায় পাঠানো হয়। 

কাকা ইবনে আমর ইতিপূর্বে ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং কাদিসিয়ার যুদ্ধের জন্য তাকে ইরাকে পাঠানো হয়েছিল। উমর ব্যক্তিগতভাবে ১,০০০ জন সৈনিক নিয়ে মদিনা থেকে অগ্রসর হন। এসকল পদক্ষেপের ফলে খ্রিষ্টান আরবরা অবরোধ তুলে নেয়। এই পর্যায়ে খালিদ তার মোবাইল গার্ডদের নিয়ে এমেসা থেকে বেরিয়ে এসে তাদের উপর আক্রমণ চালান। সিরিয়া ফিরে পাওয়ার জন্য এটি ছিল হেরাক্লিয়াসের সর্বশেষ প্রচেষ্টা।

আর্মেনিয়া ও আনাতোলিয়া অভিযান
এই যুদ্ধের পর উমর জাজিরা জয়ের নির্দেশ দেন। ৬৩৮ সালের গ্রীষ্মের শেষনাগাদ এই অভিযান সম্পন্ন হয়। জাজিরা জয়ের পর খালিদ ও জাজিরা বিজেতা আয়াজ বিন গানিম উভয়কে আবু উবাইদা জাজিরার উত্তরের বাইজেন্টাইন অঞ্চল আক্রমণের নির্দেশ দেন। তারা অগ্রসর হয়ে এডেসা, দিয়ারবাকির, মালাতিয়া জয় করেন এবং আরারাত অঞ্চল পর্যন্ত বাইজেন্টাইন আর্মেনিয়া আক্রমণ চালান। 


মানচিত্রে প্রদর্শিত খালিদ বিন ওয়ালিদের আনাতোলিয়া ও আর্মেনিয়া অভিযানের পথ

এছাড়াও তারা মধ্য আনাতোলিয়ায় আক্রমণ করেছিলেন বলে জানা যায়। হেরাক্লিয়াস ইতোমধ্যে মুসলিম নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল এবং আনাতোলিয়ার মূল ভূখন্ডের মধ্যে নো ম্যানস ল্যান্ড প্রতিষ্ঠার জন্য এন্টিওক ও তারতুসের মধ্যবর্তী দুর্গগুলি পরিত্যাগ করেছিলেন। উমর এরপর মুসলিমদেরকে আনাতোলিয়ার বেশি অগ্রসর হতে দেননি। এর পরিবর্তে তিনি আবু উবাইদাকে বিজিত অঞ্চলে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। আনাতোলিয়া ও আর্মেনিয়া অভিযান ছিল খালিদের সামরিক জীবনের সমাপ্তি।

সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুতি
খালিদ এসময় তার কর্মজীবনের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌছান। তিনি খ্যাত হয়ে উঠেন এবং মুসলিমদের কাছে তিনি জাতীয় বীর গণ্য হতেন। জনসাধারণ তাকে সাইফউল্লাহ ("আল্লাহর তলোয়ার") বলে ডাকত। খালিদ মারাশ অধিকার করার কিছুকাল পর জানতে পারেন যে খ্যাতনামা কবি আশ’আস খালিদের প্রশংসা করে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। খালিদ তাকে ১০,০০০ দিরহাম উপহার হিসেবে দেন। 

উমর এই ঘটনাকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হিসেবে বিবেচনা করেন। উমর আবু উবাইদাকে চিঠি লিখে আশ’আসকে দেয়া খালিদের অর্থের উৎস বের করার নির্দেশ দেন। বলা হয়েছিল যে যদি খালিদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেন তবে তা ক্ষমতার অপব্যবহার। আর যদি তিনি নিজের অর্থ প্রদান করেন তবে তা অপচয়। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন। আবু উবাইদাকে একাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আবু উবাইদা খালিদের গুণগ্রাহী ছিলেন এবং ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। ফলে এই দায়িত্ব পালন তার জন্য কঠিন ছিল। 

এর পরিবর্তে তিনি বিলাল ইবনে রাবাহকে এই দায়িত্ব দেন এবং খালিদকে চেলসিস থেকে এমেসায় তলব করেন। খালিদ বলেন যে তিনি নিজের অর্থ থেকে এই উপহার দিয়েছেন। তিনি আবু উবাইদার কাছে উপস্থিত হলে আবু উবাইদা তাকে জানান যে উমরের নির্দেশে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে খালিদের সামরিক জীবনের ইতি ঘটে।

বাহ্যিকভাবে উমর ও খালিদের সম্পর্ক শীতল হলেও তারা একে অন্যের প্রতি খারাপ মনোভাব পোষণ করতেন না। মৃত্যুর আগে খালিদ তার সম্পদ উমরের হাতে অর্পণ করে যান এবং উমরকে নিজ অসিয়তের বাস্তবায়নকারী মনোনীত করেছিলেন।


সিরিয়ায় খালিদ বিন ওয়ালিদের কবর

পদচ্যুতির চার বছর পর ৬৪২ সালে খালিদ ইন্তেকাল করেন। তাকে এমেসায় দাফন করা হয়। সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর থেকে তিনি সেখানে বসবাস করছিলেন। তার মাজার বর্তমানে খালিদ বিন ওয়ালিদ মসজিদের অংশ। খালিদের কবরফলকে তার নেতৃত্বাধীনে জয় হওয়া ৫০টি যুদ্ধের নাম (ছোট যুদ্ধ ব্যতীত) উৎকীর্ণ রয়েছে।  

তিনি যুদ্ধে শহিদ হতে ইচ্ছুক ছিলেন তাই বাড়িতে মৃত্যুর পূর্বে তিনি বিমর্ষ হয়ে যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি বেদনা নিয়ে বলেন :
আমি শাহাদাতের ইচ্ছা নিয়ে এত বেশি যুদ্ধে লড়াই করেছি যে আমার শরীরের কোনো অংশ ক্ষতচিহ্নবিহীন নেই যা বর্শা বা তলোয়ারের কারণে হয় নি। এরপরেও আমি এখানে, বিছানায় পড়ে একটি বৃদ্ধ উটের মতো মারা যাচ্ছি। কাপুরুষদের চোখ যাতে কখনো শান্তি না পায়।
— খালিদ বিন ওয়ালিদ

এ কথা শুনে খালিদের স্ত্রী বলেন : 

"আপনাকে সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তলোয়ার) উপাধি দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহর তলোয়ার ভাঙতে পারে না আর তাই আপনি শহিদ হিসেবে নয় বরং বিজয়ী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবেন।"

পঠিত : ৮০৩ বার

মন্তব্য: ০