Alapon

আমরা কালেক্টিভলি ব্যর্থ হচ্ছি, কিন্তু কেন এই ব্যর্থতা?

হট, সেক্সি শোনার পর যে আপুদের শিহরণে গাল লাল হয়ে যায় তাদেরকে বলছি- এগুলো কোন প্রশংসাবাচক শব্দ নয়। শব্দের উৎপত্তিগত শেকড় দেখলেই বুঝবেন চরম লেভেলের অপমান এবং অসম্মান করার জন্যই বরং এই শব্দগুলোর জন্ম। অথচ আমাদের ভাইয়েরাও কি অবলীলায় এইসব শব্দ প্রশংসার জন্য ব্যবহার করে থাকেন। মনের মধ্যে কি আছে সে কি আর কেউ জানি?

অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম আসলে এই শব্দগুলো কিভাবে ইতিবাচক হয়ে আমাদের চোখে ধরা পড়লো!

সেদিন একটা রিপোর্ট দেখলাম। সেখানে ধর্ষণের এই ফেনমেনন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বলা হয়েছে: এশিয়ায় যেহেতু হিন্দি সিনেমাতে বা বাংলা সিনেমায় নায়করাই টিজিং করে এবং নায়িকা এতে শিহরিত হয় তাই এগুলো দর্শকদের কাছেও একটা অনুসরণীয়। খুবই সামান্য লাগে এখন। মনে হয় যেন এটা কিছুই না। আর ধর্ষণের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার জন্য এইসবও অনেকটুকু দায়ী।

এভাবেই অনেক আগুন আমরা মজা করার জন্য জ্বালিয়েছি! আর সেই ম্যাচের আগুন একটু একটু করে দাবানলে রূপ নিয়েছে।



অনেক আগেও লিখেছিলাম- বাচ্চাদেরকে বাচ্চা থাকতে দেয়া উচিৎ। তাদের শৈশব কেড়ে নিয়ে তাদেরকে বড় করে ফেলা উচিৎ নয়। ওদের বাচ্চামিগুলোই কিন্তু আমাদের ভাল লাগে। ওদের ভুলগুলো কিংবা শিশুসুলভ আচরণগুলোই আমাদেরকে মজা দেয়ার কথা। কিন্তু দিনে দিনে আমরা তাদেরকেও হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছি।

এডাল্টদের মত হিল জুতো, সাজগোজ, মডেলদের মত হট সেক্সি পোশাক পরিয়ে আমরা আসলে আমাদের পরের জেনারেশনকেই তাদের নির্মল শৈশব থেকে বঞ্চিত করছি। তাদের প্রোডাক্টিভিটি এবং নৈতিক মানসকে ভেঙ্গে দিচ্ছি, গুঁড়িয়ে দিচ্ছি। তারা ধরেই নিচ্ছে এই উগ্র সাজগোজ আর অন্যের মনোরঞ্জন এবং দর্শকের টিজমূলক কথাবার্তা পেয়েই আনন্দে উদ্বেল হতে হয়! এটাই জীবন, এর মাঝেই সুখ!!!



বাবা মায়েরা যারা টিভিতে সারাক্ষণ আইটেম সং দেখতে থাকেন- আজকাল অবশ্য সব গানই আইটেম সং এ রূপ নিচ্ছে, কি রবীন্দ্র কি কমার্শিয়াল!- এইসব বাচ্চারা দেখবেন নিজেদের অজান্তেই বড় মেয়েদের বুকের দিকে তাকায়। এবং তাদের আচরণের মধ্যে একটা পাকামো পাকামো বা এডাল্ট অঙ্গভঙ্গি দেখা যায়। 
অথচ নাক টিপলে এখনো দুধ পরবে। তাদের অনেককেই জিজ্ঞেস করে জানলাম- তাদের বেশিরভাগেরই বাসায় সারাক্ষণ আইটেম সং চলতে থাকে যেখানে মেয়েদের বুকের ক্লিভেজকে জুম করে দেখানো হয়, এবং উরু, নিতম্ব এইসবকে খুব হাইলাইট করা হয়।

এই বয়সে এভাবে তাকানো বা চিন্তা করা ওদের নিজ থেকে আসার কথা না। কিন্তু আমরা জোর করে তাদের মাথায় এই ছবিগুলো সেট করছি। আর এই ছবিগুলো যে তাদেরকে পরবর্তিতে কোন খারাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? আর যে সোশ্যাল স্ট্রাকচার আর ন্যায়বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমরা চালু করে রেখেছি তাতে তো এটা যেন নাঁচুনে বুড়ির ঢোলের বাড়ির মতন অবস্থা।

আমি অনেক মেয়ে শিশুদের জিজ্ঞেস করেছিলাম-  তুমি কার মতো হতে চাও? বা বড় হয়ে কি হতে চাও? 
অদ্ভুত! তাদের অনেকেই বলেছে ঐ নায়িকার মতো সাজতে চাই, ঐ নায়িকার মতো হতে চাই, তা নাহলে তো আমার আশেপাশের ছেলেগুলো আমাকে পাত্তা দিবে না। 
তার মানে ছেলেদের কাছে সুন্দর হতে কিংবা আকর্ষনীয় হতে চাওয়ার যে পুঁজিবাদী প্রজেক্ট- এই শিশুর মধ্যে কি অবলীলায় তা ঢুকে গেল।

ক'টা পরিবার ছেলেদেরকে শিখায় মেয়েদেরকে সম্মান করতে? আর মেয়েদেরকে শিখায় ছেলেদের জন্য নয় বরং নিজের জন্য মেধাবী হও, নিজেকে গড়ে তোল, আর ছেলেদেরকেও সম্মান করো?

শিখায় না, কেউ শিখায় না।



এই বাচ্চাগুলাই তো এতবছরে বড় হয়ে হট আর সেক্সি কেউ না বললে অস্থিরতায় ভুগছে, হতাশ হচ্ছে। নিজেকে অসুন্দর মনে করছে। এই যে এত ধর্ষন হচ্ছে বলি, কেউ পোশাককে দোষ দিচ্ছে, কেউ ধর্মকে দোষ দিচ্ছে, আসল কথা কি বলি?

বেলুনে একটা ফুঁটো নয়, হাজারটা ফুঁটো। আমরা কালেক্টিভলি ব্যার্থ হয়েছি একটি নৈতিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে।

এটা কিভাবে কমবে জানেন?

♦️প্রথমতঃ পরিবারে একদম ছোটবেলা থেকে নিজেকে সম্মান করা, নিজের আচার আচরণগুলোকে সুন্দর করতে শিখানো, আত্মনিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ করা অনেক জরুরী।

♦️দ্বিতীয়তঃ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করা, ক্ষমতা থাকলেই কাউকে নির্যাতন করা যাবে, ইচ্ছা মত ধর্ষন করা যাবে এমন চিন্তা থেকে ক্ষমতাবানদেরকে নিবৃত্ত করা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। দু'চারটাকে পাব্লিকলি এক্সিকিউট করা।

♦️তৃতীয়তঃ আমি জানি আমার এই লেখা শেয়ার হলে অনেক ধর্ষকরাও পড়বেন। তাদেরকে বলছি- আপনারা তো এমনিতেই খারাপ মানুষ, ভাল হতে চান না, হবেন ও না হয়তো। যদি নিজের বৌকে ভাল না লাগে বা একা হন- আপনার কামনা জাগ্রত হলে মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়েও আপনি কাজ সারতে পারেন, পতিতালয়গুলো আপনার অপেক্ষায়। তবুও কারো সম্ভ্রমে হামলা করবেন না।

প্রতিটি মেয়ের নিজের ইজ্জত সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে, না, আসলে প্রতিটি মানুষেরই আছে, মেয়েদেরকে তো মানুষের সম্মানটা আগে দিতে হবে।

দেশ অনেক এগিয়েছে, মেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে সকল ক্ষেত্রে এখন প্রচুর অংশগ্রহণ করছে, আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসম্মানিত হওয়ার সংখ্যা।

আমি একজন নারী, আপনারই বোন, কিংবা বধূ, কিংবা মা, অথবা খালা, চাচী, মামী ফুপু। আমি আপনারই অংশ। আমি সুস্থ থাকলেই আপনি ও আপনারা সুস্থ থাকবেন। ভালো থাকবে বাংলাদেশ।

পঠিত : ৮৪১ বার

মন্তব্য: ০