Alapon

প্রতিবাদের ভাষা হোক শিল্পিত

১. আমি যখন ২০০৪ সালে ঢাবিতে এডমিশন নিয়ে প্রথম হলে উঠেছিলাম, তখন দুর্বার গতিতে হলে চলছে প্রভোস্ট হঠাও আন্দোলন।সদ্য ঢাকায় আগত আমার মতো মফস্বলের এক মেয়ের কাছে সে ছিলো ভারি মজার বিষয়! কেননা, আমার তখন সবকিছুতেই অপরিসীম কৌতূহলের যুগ চলছে।সব কিছুতেই বিস্ময়! সবকিছুতেই মুগ্ধতা!  তিনরাস্তার ব্যস্ততম মোড়ে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে পিঠাওয়ালীদের ঝগড়া,চুলটানাটানি যেখানে পরম মুগ্ধতা নিয়ে উপভোগ করতে ছাড় দিতাম না, সেখানে হল আন্দোলনের মতো  মহা হাঙ্গামার বিষয়তো আসমানের চাঁদ! তাই প্রভোস্ট ম্যাডাম আসলে কী দোষে দুসি, সেটির আগামাথা না জেনেই হলের সিনিয়র আপুদের সাথে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিতাম : " প্রভোস্টের দুইগালে জুতা মারো তালে তালে!" কিংবা প্রভোস্টের চামড়া, তুলে নেবো আমরা!" জ্বালোরে জ্বালো! আগুন জ্বালো!"

সমস্বরে এগুলো বলার মধ্যে একধরণের বুনো আনন্দ টের পেতাম ! আবার যে মেয়েগুলোকে রাত নটার মধ্যে ঘন্টা বাজিয়ে হলের মধ্যে বন্দী করে ফেলা হয়, সেই মেয়েগুলো যদি হঠাত রাতবারোটায় হলের তালা ভেঙ্গে বাইরে যাবার উপলক্ষ পায়, তবে তার মধ্যদিয়ে সে উপভোগ করে প্রথাবিরোধী  মুক্তির স্বাদ! 

তো যাইহোক প্রভোস্ট ম্যাডাম তখন হল ছাড়তে বাধ্যহয়েছিলেন বটে, কিন্তু আমি কেমন জানি এই সংলাপগুলো মেনে নিতে পারি নি। কেবলি মাথায় ঘুরপাক খেতো সম্মানীয় লোককে কীভাবে এমন করে বলা যায়! বান্ধবীদের কাউকে কাউকে বলাতে, আমায় থামিয়ে দিয়ে বলেছিলো: তুই চুপথাক! এগুলো আন্দোলনের ভাষা! বলা দোষের নয়!

২. এরপর আসলো নতুন যুগ। যে যুগে খরা, সুনামি, বন্যা,লঞ্চডুবিসহ যেভাবেই মানুষ মারা যাক না কেনো, মৃতের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারি কোষাগার থেকে দেয়া হতো ছাগল! তা আবার যেই সেই জাতের নয়! একেবারে উন্নত জাতের ব্লাকবেঙ্গল ছাগল! 
তো, সেই নতুন যুগের ধারক হিসেবে আসলেন নতুন প্রভোস্ট ম্যাডাম। ভারি সুন্দর দেখতে,  হেব্বি স্মার্ট, স্টাইলিশ! মেয়েরাও খুশি হলো, ভাবলো যাক, এবার ম্যডামের সৌন্দর্য হলেও ছাপিয়ে যাবে সর্বত্র। কিন্তু বিধি বাম!

ম্যাডাম হলে এসেই সরকারকে খুশি রাখতে হলের মধ্যেই শুরু করলেন ছাগল পালন! একটা দুইটা নয়! বাবা,মা, ছেলে,মেয়ে নাতী নাতনীসহ পুরা ছাগলের একপাল! আমরা অবাক বিস্ময়ে শুধু দেখে যেতে থাকলাম কিভাবে সাজানো ফুলের বাগান, সবুজ কচি ঘাস বিলীন হয়ে অচিরেই হল পরিণত হলো রুক্ষ মরুভূমিতে! ফুলেল ভুমি ভরে গেলো ছাগলের গুটি গুটি কালো নাদায়! এখানেই শেষ নয়! 
হলের ফিস্টগুলো ম্যডাম দিলেন সংকুচিত করে।লন্ড্রি, খরচ, ফটোকপি খরচ সবকিছুর দাম বাড়লো! ইফতারে, ফলমুল,পিয়াজু ছোলার মতো মুখরোচক খাবারের বদলে ধারয হলো ডিমসিদ্ধ,প্যাকেট দুধ!

মাঠের কন্সার্ট দেখতে একমেয়ে পেয়ারা গাছে উঠে সামান্য আঘাত পাওয়ায়, ম্যাডাম হলের পুরো পেয়ারা বাগান ডাল কেটে বিলীন করে দিলেন! মাথা ব্যাথায় মাথাকাটা যাকে বলে! ভীষণ রাগহলো আমার! ইস!  কতদিন এই ডাসা ডাসা পেয়ারা খেয়েউদর ভরেছি! আর আজ!

কিন্তু এসবের প্রতিকার নেই! কেউ আওয়াজ তুল্লেই হলের সিট বাতিল! ম্যাডাম তো আছেন ই, তার উপর আছেন বাঁশের চেয়ে কঞ্চির জোর বেশিওয়ালা ছাত্রনেত্রী!
সবকিছু যখন এভাবে প্রতিকারহীণ নষ্টদের অধিকারে চলে যাচ্ছে তখন আমি এক দারুণ প্লান আটলাম!

হলের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে করলাম গম্ভীরা গান। বলাবাহুল্য এই গানের পুরো বিষয় ছিলো ম্যাডামের ছাগল পালন থেকে শুরু করে পেয়ারাগাছ নিধন পর্যন্ত সবকিছুই! আমার  দাড়ি লাগিয়ে, পায়ে ঘুঙুর বেধে কৃতিম ভুড়িদোলানো নাচের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ভাষায় তখন পুরো হলরুম মুগ্ধ! হলের আপুরা হাততালি দিয়ে,সিটি বাজিয়ে পরম উতসাহ দিতে লাগলেন। হাউস টিউটর ম্যাডামরা, ডাইনিং,লন্ড্রির মামারা হেসে কুটি কুটি! যেনো এত দিনের না বলতে পারা কথাগুলো, না বলা ক্ষোভ, অভিমান আমি তাদের হয়ে নিমিষেই বলে দিচ্ছি! 

প্রভোস্ট ম্যডাম চারপাশের এমন মুখর পরিবেশ দেখে দাঁতে দাঁত কামড়ে কোনোমতে মুখে হাসিটি ঝুলিয়ে রেখে বিদেয় হয়েছিলেন!

ফলাফল, সেবারের বৈশাখে পুরো হল মাটন বিরিয়ানির স্বাদ পেয়েছিলো! ম্যাডাম আমতা আমতা করে বলেছিলেন: আমিতো তোমাদের নিজের হাতের ফ্রেশ মাটন খাওয়াবো বলে এগুলো পুষেছিলাম! তা না হলে.... হা হা।

৩. সরকার বদলে এরপর আসলেন আরেক পশুপ্রেমিক ম্যডাম! ইনি আবার সরকারি এজেন্ডা নয়, মন থেকেই পশু ভালবাসতেন! জুওলজি পড়ানো ম্যাডাম কি না! উনি আসার পর হলে বিড়ালের অত্যাচাড় কেন জানি খুব বেড়ে গেলো!

 এক হুলো বেড়ালের ছিলো বেজায় ডিমান্ড! উনি রাত বিরোত ডজন খানিক গারলফ্রেন্ড নিয়ে চলাফেরা করতেন! আর ওনার হেরেমে ছিলো অসংখ্য বৃদ্ধা,  যুবতি,বালিকা বেড়াল! এনারা প্রায়শই মেয়েদের রাতবিরোত চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটাতেন। আবার গভীর রাতে শোনা যেতো ছাদের উপর ইভটিজিং এর শিকার হওয়া বিড়ালের কাতর চিৎকার! মুশকিল হলো এই বিড়াল বাহিনীর খাবার যোগান দিতে হতো হলের কোনো মতে ডালভাত রান্না করে খেয়ে  থাকা আপুদের। কস্টের রান্নাকরা মাছ,  মাংস সব চলে যেতো এনাদের পেটে। আবার "যেই পাত্রে খাই, সেই পাত্রেই হাগু করি" এই ছিলো তাদের নীতি! সারা হলময় ছড়িয়ে পড়লো বিড়ালের হাগুর অসহ্য কটু গন্ধ! 

মেয়েরা সহ্যক্ষমতা হারিয়ে যখন ম্যাডামের কাছে প্রতিকার চাইতে গেলো, ম্যাডাম মাথা নেড়ে হাসিমুখে বলে দিলেন,  "উহু! আমি প্রাণিবিদ্যার ম্যাডাম হয়ে প্রাণি নিধন করতে পারবো না! হ্যা, তবে তোমরা চাইলে বিড়ালগুলোকে মায়া বড়ি খাইয়ে দাও! ফ্যামিলি প্লানিং হয়ে যাবে! হা হা!"

উনিতো হেসেই শেষ করলেন, কিন্তু মেয়েদের মাথায় হাত! আমি সেদিনের পড়া ফেলে রচনা করলাম বিখ্যাত এক প্যারোডি কবিতা। মনে আছে ক্যালেন্ডারের পেছনের সাদা অংশে মারকার দিয়ে গোটা হরফে লিখে ডাইনিং এর দেয়ালে টানিয়ে দিয়েছিলাম রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর "বাতাসে লাশের গন্ধ" কবিতার প্যারোডি :
"বাতাসে গু এর গন্ধ!"

সবটা মনে নেই আজ। তবে কিছু অংশ ছিলো এমন:
" আজো আমি বাতাসে গুয়ের গন্ধ শুনতে পাই,
ধর্ষিতা বিড়ালের কাতর চিৎকার শুনি ছাদের উপর!....
হল প্রশাসন!
থামাও তোমার দু: শাসন।
জানোতো, পুরাণে দ্রোপদীর বস্ত্র হরণ হতে হতে শেষরক্ষা পেয়েছিলো!
কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নির্মম মৃত্যু ঘটেছিলো দু: শাসনের!"

ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিলো এই কবিতা।বিড়াল উধাওয়ের পাশাপাশি প্রভোস্ট ম্যাডাম ডেকে নিয়ে পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন : দারুণ প্রতিভা! পড়ালেখায় কাজে লাগাও! "
ম্যডামকে কে জানি বলে দিয়েছিলো এটা সোহেলী পাজিটার কাজ! হা হা

৪. সম্প্রতি কোটা আন্দোলনের কিছু প্রতিবাদী ভাষা, স্লোগান,ব্যঙ্গচিত্র যেমন মন ছুঁয়েগেছে তেমনি ছাত্রদের হাতেথাকা কিছু পোস্টারের ভাষা দেখে যারপরনাই ব্যথিত হয়েছি।ভালো লাগার মাঝে ছিলো: " একদিকে কোটা জাতি, একদিকে গোটা জাতি!" বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাই নাই"  "কোটায় নয় কামলা, মমেধায় হোক আমলা"এরকম পোস্টার গুলো।কোটা দিয়ে আমপাড়া বিষয়ক ব্যংগচিত্রটিও মেধার পরিচয়ক।

কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলনের বিরোদ্ধে এক দল খুব বাজে বক্তব্য, শ্লোগান লিখে ফেইসবুকে প্রচার করতে দেখেছি। যা ছিলো খুবই দৃষ্টিকটু। ছাত্র পরিচয় দিয়ে বস্তির ছেলেপেলের মতো শ্লোগান খুবই ন্যাক্কারজনক।
ধিক! সেই সকল ছাত্রনামধারী কুলাংগারদের জন্য।

৫. আজকাল আরো একটি ট্রেন্ড শুরু হয়েছে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করতে চাইলেই তাকে, জামাত শিবির, রাজাকার বানিয়ে ফেলা। গ্রীষ্ম কালের ওয়াজ যেমন শীতকালে জমে না তেমনি এই এত অবলীলায় ব্যক্তিগত প্রতিহিংসায় যাকে তাকে জামাত শিবির বানিয়ে ফেললে হবে কি, এই আচ্ছাদনে সত্যিকারের জংগীগোষ্ঠী আড়াল হবার সুযোগ পাবে।এ যেনো সেই রাখাল বালকের গল্প: বাঘ এলরে! বাঘ এলরে! কিন্তু যেদিন বাঘ এল, সেদিন কেউই এল না!

 আর,স্থান কাল পাত্রের বিবেচনা না রেখে প্রকাশ্যে সবাইকে রাজাকার বলার প্রভাবতো সবাই দেখতেই পেলাম। থেমে যাওয়া আন্দোলন উত্তাল হলো। সরকার কোটা বিলীনে বাধ্য হলো!

পঠিত : ১০৬৮ বার

মন্তব্য: ০