Alapon

ইসলাম পূর্ব আরবের অবস্থা (পর্ব-১)

আজ আমরা জানতে চেষ্টা করবো প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদের অবস্থা সম্পর্কে। একটু গভীর ভাবে খতিয়ে দেখবো আরবরা কি সভ্য ছিলো নাকি সত্যিই বর্বর জাতি ছিলো? স্বচক্ষে দেখবো তাদের জীবন চিত্র, জানবো আরবদের ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে, আরো জানবো পরোকাল সম্পর্কে তাদের চিন্তাধারা। তাহলে শুরু করা যাক-


ছবিঃ প্রাচীন আরব, সূত্রঃ google earth

ইসলামপূর্ব আরব জাতি কি সভ্য ছিল?

‘তামাদ্দুনে ইসলাম ওয়া আরাব’ গ্রন্থের রচয়িতা জাহেলী যুগের আরব জাতির অবস্থা অধ্যয়ন ও গবেষণা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আরবগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সভ্য ছিল। আরব ভূখণ্ডের বিভিন্ন স্থানে আরবদের বিদ্যমান বৃহৎ ও উঁচু ইমারতসমূহ এবং সে সময়ের সভ্য জাতিসমূহের সাথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক তাদের সভ্যতা ও সভ্য হওয়ার প্রমাণস্বরূপ। কারণ যে জাতি রোমান জাতির আবির্ভাবের আগে উন্নত শহর ও নগর স্থাপন করেছিল এবং বিশ্বের বড় বড় জাতির সাথে যাদের ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল সে জাতিকে অসভ্য-বর্বর জাতি বলা যায় না।

পুনশ্চ, আরবী সাহিত্য এবং আরবদের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার অধিকারী হওয়া তাদের সভ্যতার শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত হওয়ারই প্রমাণস্বরূপ। তাই লেখকের বক্তব্য : “আমরা যদি ধরেও নিই যে, আরব উপদ্বীপের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জ্ঞাত ছিলাম না, এরপরও আমরা আরব জাতির অসভ্য হওয়া সংক্রান্ত তত্ত্বটি প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম। একটি জাতির ভাষা সংক্রান্ত যে বিধান সে একই বিধান উক্ত জাতির সভ্যতা সম্পর্কেও প্রযোজ্য। উক্ত জাতির সভ্যতা ও ভাষা একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করে থাকতে পারে।


ছবিঃ প্রাচীন শিলালিপি, সুত্রঃ wiki

তবে তার ভিত্তিসমূহ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রাচীন এবং সুদূর অতীতকাল থেকে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করেছে। কোন পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ ও ভূমিকা ছাড়াই সংশ্লিষ্ট সাহিত্যসহ কোন ভাষার উদ্ভব ও উন্মেষ সম্ভব নয়। অধিকন্তু সভ্য জাতিসমূহের সাথে সম্পর্ক স্থাপন একটি যোগ্যতাসম্পন্ন জাতির ক্ষেত্রে সর্বদা উন্নতি ও প্রগতির কারণ বলে গণ্য।” উপরিউক্ত লেখক ইসলামপূর্ব আরব জাতির একটি উন্নত ও সুদীর্ঘ সভ্যতা প্রমাণ করার জন্য গ্রন্থের কয়েকটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ করেছেন। তাঁর তত্ত্ব তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।

এগুলো হচ্ছে :
১. অতি উন্নত একটি ভাষার (আরবী ভাষা) অধিকারী হওয়া।
২. উন্নত দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং 
৩. ইয়েমেনের আশ্চর্যজনক ইমারতসমূহ-যা খ্রিষ্টের জন্মের পূর্বে হেরোডোট (Herodote) ও আরটিমিডোর (Artemidor) নামীয় দু’জন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক এবং মাসউদী ও অন্যান্য মুসলিম ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন।

আলোচনার অবকাশ নেই যে, আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে সীমিত পরিসরে বিভিন্ন সভ্যতা ছিল। তবে লেখক যে সব দলিল-প্রমাণ তাঁর গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন তা থেকে প্রমাণিত হয় না যে, আরবের সর্বত্র সভ্যতা ছিল।


ছবিঃ history of arab

এটি ঠিক যে, সভ্যতার সকল নিদর্শনের সাথেই একটি ভাষার পূর্ণ বিকাশ হয়ে থাকে। তবে আরবী ভাষাকে স্বাধীন-স্বতন্ত্র এবং হিব্রু, সুরিয়ানী, আশুরী ও কালদানী ভাষার সাথে সংশ্লিষ্টহীন বলে বিশ্বাস করা যায় না। কারণ বিশেষজ্ঞদের সত্যায়ন ও সাক্ষ্য অনুসারে এ সব ভাষা এক সময় একীভূত একক ভাষা ছিল এবং একটি আদি ভাষা থেকে এগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ধারণা করা যায় যে, ইব্রানী (হিব্রু) অথবা অ্যাসীরীয় ভাষাসমূহের মাঝেই আরবী ভাষা পূর্ণতা লাভ করেছে। আর পূর্ণতা লাভ করার পর তা স্বাধীন-স্বতন্ত্র ভাষার রূপ পরিগ্রহ করেছে।

নিঃসন্দেহে বিশ্বের উন্নত জাতিসমূহের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখা উন্নতি ও সভ্যতার পরিচায়ক। কিন্তু সমগ্র আরব উপদ্বীপে কি ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল অথবা প্রধানত হিজায অঞ্চলটি কি এ ধরনের সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত ছিল? অন্যদিকে ইরান ও রোম সাম্রাজ্যের সাথে হিজাযের দু’টি সরকার শাসিত অঞ্চলের (হীরা ও গাসসান) সম্পর্ক থেকে আরব জাতির সভ্যতার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। কারণ উক্ত সরকারদ্বয় সম্পূর্ণরূপে বিদেশী শক্তির সমর্থন ও মদদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। আজও আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশই পাশ্চাত্য দেশসমূহের উপনিবেশ। কিন্তু ঐ সব দেশে প্রকৃত পাশ্চাত্য সভ্যতার কোন নিদর্শনই বিদ্যমান নেই।

তবে ইয়েমেনের সাবা ও মারিব-এর আশ্চর্যজনক সভ্যতাকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ তাওরাতে যে বিবরণ রয়েছে তা এবং হেরোডোট ও অন্যান্য ঐতিহাসিক যা বর্ণনা করেছেন সেগুলো ছাড়াও প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মাসউদী মারিব সম্পর্কে লিখেছেন : “সব দিক থেকে মারাব সুরম্য অট্টালিকা, ছায়াদানকারী বৃক্ষ, প্রবাহমান ঝরনা ও নদী দিয়ে পরিবেষ্টিত ছিল। আর দেশটি এত বড় ছিল যা একজন সামর্থ্যবান অশ্বারোহী এক মাসেও তা পাড়ি দিতে পারত না।


ছবিঃ প্রাচীন ইয়েমেন সভ্যতা, সুত্রঃ RTVE.es

আরোহী ও পায়ে হেঁটে ভ্রমণকারী সকল পরিব্রাজক ও মুসাফির যারা এ দেশটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত গমন করত তাদের কেউই সূর্যালোক দেখতে পেত না। কারণ রাস্তার দু’পাশ জুড়ে থাকত ঘন ছায়াদানকারী বৃক্ষরাজি। দেশটির সবুজ-শ্যামল শস্যক্ষেত্রসমূহ এবং স্থায়ী রাজকীয় সরকার ও প্রশাসন সমগ্র বিশ্বে তখন খুবই প্রসিদ্ধ ছিল।

সংক্ষেপে এ সব দলিল-প্রমাণের অস্তিত্ব সমগ্র আরব ভূখণ্ড জুড়ে বিরাজমান সভ্যতার অস্তিত্ব প্রমাণ করে না; বিশেষ করে হিজায অঞ্চলে এ ধরনের সভ্যতার কোন অস্তিত্বই বিদ্যমান ছিল না, এমনকি গোস্তাব লোবোঁ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন : “আরব উপদ্বীপ কেবল উত্তরের সীমান্ত এলাকাসমূহ ব্যতীত সকল বৈদেশিক আক্রমণ ও জবরদখল থেকে মুক্ত থেকেছে এবং কোন ব্যক্তি সমগ্র আরব ভূখণ্ড নিজের করায়ত্তে আনতে পারেনি। পারস্য, রোম ও গ্রীসের বড় বড় দিগ্বিজয়ী যাঁরা সে যুগের সমগ্র বিশ্ব তছনছ করেছেন তাঁরা আরব উপদ্বীপের প্রতি খুব কমই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন।”

যদি এ কথা স্বীকার করে নেয়া হয় যে, সমগ্র আরব উপদ্বীপব্যাপী ঐ সকল পৌরাণিক সভ্যতা বাস্তবতার নিকটবর্তী; তারপরেও অবশ্যই বলতে হয় যে, ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের সময় হিজায অঞ্চলে আসলে সভ্যতার কোন নিদর্শনই বিদ্যমান ছিল না। পবিত্র কোরআন এ বিষয়টি উল্লেখ করেছে :
و كنتم على شفا حفرة من النّار فأنقذكم منها
“হে আরব জাতি! (ইসলাম ধর্মে তোমাদের দীক্ষিত ও বিশ্বাস স্থাপনের পূর্বে) তোমরা জাহান্নামের আগুনের নিকটে ছিলে। অতঃপর মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে (ইসলামের মাধ্যমে) মুক্তি দিয়েছেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)

প্রাক ইসলামী যুগে আরবের অবস্থা

ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা জানার জন্য নিম্নোক্ত সূত্রসমূহ ব্যবহার করা যেতে পারে :
১. তাওরাত যদিও এতে সকল ধরনের বিকৃতি রয়েছে;
২. মধ্যযুগীয় গ্রীক ও রোমান সাহিত্য ও বিবরণাদি;
৩. মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক প্রণীত ইসলামের ইতিহাস;
৪. প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও খনন কার্য এবং প্রাচ্যবিদগণের গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনাদি। আর এগুলো সীমিত পরিসরে হলেও বেশ কিছু অজানা বিষয়ের ওপর থেকে রহস্যের জট খুলেছে।

এ সব সূত্র থাকা সত্ত্বেও আরব জাতির ইতিহাসের অনেক দিক ও বিষয় এখনো অস্পষ্ট থেকে গেছে এবং এমন এক ঐতিহাসিক ধাঁধার রূপ পরিগ্রহ করেছে যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু যেহেতু ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা কিরূপ ছিল তা  খুব সংক্ষেপে আমরা এখানে বর্ণনা করব।

নিঃসন্দেহে আরব উপদ্বীপে সুদূর অতীতকাল থেকেই বহু গোত্র বসতি স্থাপন করেছে। এ সব গোত্রের মধ্য থেকে কতিপয় গোত্র বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে কেবল তিনটি প্রধান গোত্র অন্য সকল গোত্রের চেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেছে। আর এ তিন গোত্র থেকে বহু শাখাগোত্রের উৎপত্তি হয়েছিল।

 এ গোত্র তিনটি হলো :
১. বায়েদাহ্ (بائدة) : বায়েদাহ্ শব্দের অর্থ ধ্বংসপ্রাপ্ত। কারণ এ গোত্র অবাধ্যতা ও পাপাচারের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে নিশ্চি‎‎‎হ্ন হয়ে গেছে। সম্ভবত ধ্বংসপ্রাপ্ত গোত্রগুলো আদ ও সামুদ জাতি হয়ে থাকবে-যাদের বর্ণনা পবিত্র কোরআনে বহুবার এসেছে।


ছবিঃ প্রাচীন আরব গ্রোত্র, সূত্রঃ Arab tribe

২. কাহ্তানিগণ (القحطانيون) : এরা ইয়া’রব বিন কাহ্তানের বংশধর। এরা আরব ভূখণ্ডের দক্ষিণাঞ্চল অর্থাৎ ইয়েমেনে বসবাস করত। এদেরকেই খাঁটি আরব বলা হয়। আজকের ইয়েমেনের অধিবাসীরা এবং আওস ও খাযরাজ গোত্র যারা ইসলামের আবির্ভাবের শুরুতে মদীনায় বসবাস করত তারা কাহ্তানেরই বংশধর। কাহ্তানিগণ অনেক সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা ইয়েমেনকে সমৃদ্ধশালী ও আবাদ করার ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছে। তারা বহু সভ্যতারও গোড়াপত্তন করেছিল এবং সেগুলোর নিদর্শনাদি আজও বিদ্যমান। তাদের রেখে যাওয়া প্রাচীন শিলালিপিসমূহ বৈজ্ঞানিক নীতিমালার ভিত্তিতে পাঠোদ্ধার করা হচ্ছে। এর ফলে কাহ্তানীদের ইতিহাস কিছুটা হলেও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির সভ্যতা সম্পর্কে যা কিছু আলোচনা করা হয় আসলে তার সবই এ কাহ্তানীদের সাথেই সংশ্লিষ্ট এবং এ সভ্যতার বিকাশস্থল হচ্ছে ইয়েমেন।


ছবিঃ প্রাচীন আরব গ্রোত্র, সূত্রঃ Arab tribe

৩. আদনানিগণ (العدنانيّون) : এরা হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর। ইসমাঈল (আ.) ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র। এ গোত্রের উৎসমূল আমরা পরবর্তী আলোচনাসমূহে স্পষ্ট করে দেব। তবে উক্ত আলোচনাসমূহের সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ : পুত্র ইসমাঈলকে তাঁর মা হাজেরাসহ পবিত্র মক্কায় পুনর্বাসন করার ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম (আ.) আদিষ্ট হন। তিনি ইসমাঈল ও তাঁর মা হাজেরাকে ফিলিস্তিন থেকে একটি গভীর উপত্যকায় নিয়ে আসলেন যা মক্কা নামে অভিহিত। এ উপত্যকা ছিল পানি ও উদ্ভিদবিহীন মরুপ্রান্তর। মহান আল্লাহ্ তাঁদের ওপর করুণা ও রহমতস্বরূপ সেখানে ‘যমযম’ ঝরনা সৃষ্টি করে তাঁদের হাতে অর্পণ করেন। ইসমাঈল (আ.) মক্কার অদূরে বসতি স্থাপনকারী জুরহুম গোত্রের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি অনেক সন্তান-সন্ততি লাভ করেছিলেন। হযরত ইসমাঈলের এ সব বংশধরের একজন ছিলেন আদনান। কয়েকজন ঊর্ধ্বতন পিতৃপুরুষের মাধ্যমে আদনানের বংশ হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর সাথে মিলিত হয়।

আদনানের সন্তান ও বংশধরগণ বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে যায়। এ সব গোত্রের মধ্যে যে গোত্রটি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছিল তা হলো কুরাইশ গোত্র। আর বনি হাশিম ছিল কুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।


ছবিঃ প্রাচীন আরব গ্রোত্র, সূত্রঃ Arab tribe

ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা বর্ণনা করে হযরত আলী (আ.)-এর যে সব বক্তব্য আছে সেগুলো হচ্ছে এতৎসংক্রান্ত জীবন্ত দলিল। এ সব বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, জীবনযাপন পদ্ধতি, চিন্তামূলক বিচ্যুতি ও নৈতিক অধঃপতনের দিক থেকে আরব জাতি অত্যন্ত দুঃখজনক অবস্থার মধ্যে ছিল। হযরত আলী তাঁর একটি ভাষণে ইসলামপূর্ব আরব জাতির অবস্থা ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছেন :

“মহান আল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্বাসীদের ভয় প্রদর্শনকারী ঐশী প্রত্যাদেশ ও গ্রন্থের (আল কোরআন) বিশ্বস্ত আমানতদার হিসাবে প্রেরণ করেছেন। হে আরবগণ! তখন তোমরা নিকৃষ্ট ধর্ম পালন ও নিকৃষ্টতম স্থানসমূহে বসবাস করতে। তোমরা প্রস্তরময় স্থান এবং বধির (মারাত্মক বিষধর) সর্পকুলের মাঝে জীবনযাপন করতে (সেগুলো এমন বিষধর সাপ ছিল যা যে কোন প্রকার শব্দে পলায়ন করত না), তোমরা নোংরা লবণাক্ত-কর্দমাক্ত পানি পান করতে, কঠিন খাদ্য (খেজুর বীজের আটা এবং গুঁইসাপ) খেতে, একে অপরের রক্ত ঝরাতে এবং নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের থেকে দূরে থাকতে। তোমাদের মধ্যে মূর্তি ও প্রতিমাপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তোমরা কুকর্ম ও পাপ থেকে বিরত থাকতে না।”

আমরা এখানে আসআদ বিন যুরারার কাহিনী উল্লেখ করব যা হিজাযের অধিবাসীদের জীবনের অনেক দিক উন্মোচন করতে সক্ষম।


ছবিঃ প্রাচীন আরব গ্রোত্র, সূত্রঃ Arab tribe

মদীনায় বসবাসকারী আওস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে বহু বছর ধরে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের লেলিহান শিখা প্রজ্বলিত ছিল। একদিন আসআদ বিন যুরারাহ্ নামক খাযরাজ গোত্রের একজন নেতা মক্কা গমন করল যাতে করে কুরাইশদের আর্থিক ও সামরিক সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে ১০০ বছরের পুরানো শত্রু আওস গোত্রকে পদানত করতে সক্ষম হয়। উতবাহ্ বিন রাবীয়ার সাথে তার পুরানো বন্ধুত্ব থাকার সুবাদে সে উতবার গৃহে গমন করল এবং তার কাছে নিজের মক্কা আগমনের কারণও উল্লেখ করল। সে উতবার কাছে সাহায্য চাইলে তার পুরানো বন্ধু উতবাহ্ তাকে বলল, “আমরা তোমার অনুরোধ ও আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিতে পারব না। কারণ বর্তমানে আমরা এক অদ্ভুত অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছি। 

আমাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি আবির্ভূত হয়ে আমাদের উপাস্যদের সম্পর্কে কটুক্তি করছে। সে আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে নির্বোধ ও স্বল্প বুদ্ধির অধিকারী বলে মনে করে এবং মিষ্টি-মধুর ভাষা ব্যবহার করে আমাদের একদল যুবককে তার নিজের দিকে টেনে নিয়েছে। আর এভাবে আমাদের নিজেদের মাঝে এক গভীর ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। হজ্বের মৌসুম ব্যতীত অন্য সময় এ লোকটি শেবে আবু তালিবে (আবু তালিবের গিরিদেশে) বসবাস করে এবং হজ্বের মৌসুমে গিরিদেশ থেকে বের হয়ে হিজরে ইসমাঈলে (কাবা শরীফের কাছে) এসে বসে এবং জনগণকে (হজ্ব উপলক্ষে আগত ব্যক্তিদেরকে) তার ধর্মের প্রতি আহবান জানায়।”

আসআদ অন্যান্য কুরাইশ গোত্রপতির সাথে যোগাযোগ করার আগেই মদীনা প্রত্যাবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সে আরবদের সনাতন প্রথা অনুযায়ী কাবাঘর যিয়ারত করতে আগ্রহী হয়। তবে উতবাহ্ তাকে এ ব্যাপারে ভয় দেখিয়েছিল যে, সে তাওয়াফ করার সময় ঐ লোকটির (রাসূলের) কথা শুনবে এবং তার মধ্যে তার প্রভাব বিস্তার করবে। অন্যদিকে কাবাঘর তাওয়াফ ও যিয়ারত না করে পবিত্র মক্কা নগরী ত্যাগ করাও খুবই অশোভন ও মর্যাদাহানিকর বলে এ সমস্যা সমাধান করার উদ্দেশ্যে উতবাহ্ আসআদকে প্রস্তাব করল সে যেন তাওয়াফ করার সময় কানের ভিতর তুলা দিয়ে রাখে, তাহলে সে ঐ লোকটির কথা শুনতে পাবে না।


ছবিঃ প্রাচীন কাবা, সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

আসআদ ধীরে ধীরে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে তাওয়াফ করায় মশগুল হলো। প্রথম তাওয়াফেই তার দৃষ্টি মহানবী (সা.)-এর ওপর নিবদ্ধ হলো। সে দেখতে পেল এক ব্যক্তি হিজরে ইসমাঈলে বসে আছে। কিন্তু মহানবীর কথায় প্রভাবিত হওয়ার ভয়ে সে তাঁর সামনে আসল না। অবশেষে সে তাওয়াফ করার সময় ভাবল, এ কেমন বোকামিপূর্ণ কাজ করছি! আগামীকাল যখন মদীনায় এ ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তখন আমি কি জবাব দেব। তাই আসআদ বুঝতে পারল যে, এ বিষয়ে তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন।

আসআদ একটু সামনে এগিয়ে এসে জাহেলী আরবদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী সালাম দিয়ে বলল, أنعم صباحا “আপনার প্রাতঃকাল মঙ্গলময় হোক।” মহানবী (সা.) এর জবাবে বললেন, “আমার প্রভু মহান আল্লাহ্ এর চেয়ে উত্তম সম্ভাষণ ও সালাম অবতীর্ণ করেছেন। আর তা হচ্ছে : سلام عليكم (আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক)।” তখন আসআদ মহানবীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। মহানবী আসআদের এ প্রশ্নের জবাবে সূরা আনআমের ১৫১ ও ১৫২ নং আয়াত-যা আসলেই জাহেলী আরবদের মন মানসিকতা, আচার-আচরণ ও রীতিসমূহ চিত্রিত করেছে তা পাঠ করলেন। এ দু’আয়াত-যা ১২০ বছর ধরে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত একটি জাতির সকল ব্যথা-বেদনা ও দুঃখ-দুর্দশা এবং এর উপশম ও সমাধান সম্বলিত ছিল তা আসআদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব বিস্তার করল। এ কারণে সে তৎক্ষণাৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল এবং মহানবীর কাছে আবেদন জানাল-যেন তিনি এক ব্যক্তিকে মুবাল্লিগ হিসাবে মদীনায় প্রেরণ করেন। মহানবী আসআদের অনুরোধে মুসআব ইবনে উমাইরকে পবিত্র কোরআন এবং ইসলামের শিক্ষক হিসাবে মদীনায় প্রেরণ করলেন।

উক্ত আয়াতদ্বয়ের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু নিয়ে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই জাহেলী আরবদের অবস্থা সম্পর্কে গবেষণা ও অধ্যয়ন করার আর কোন প্রয়োজন থাকবে না। কারণ এ দু’আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দীর্ঘদিনের চারিত্রিক ব্যাধিসমূহ জাহেলী আরবদের জীবনকে হুমকির সম্মুখীন করেছিল। এ কারণে এখানে আয়াতদ্বয়ের আরবী ভাষ্য ও এর অনুবাদ সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ শ্রদ্ধেয় পাঠকবর্গের সামনে তুলে ধরা হলো :

“(হে মুহাম্মদ!) বলে দিন : আমার রিসালাতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ ব্যাখ্যা করব। আমার রিসালাতের লক্ষ্যসমূহ নিম্নরূপ :
১. আমি শিরক ও মূর্তিপূজার মূলোৎপাটন করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।
২. আমার কর্মসূচীর শীর্ষে আছে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করা।
৩. আমার ধর্মে দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা সবচেয়ে মন্দ কাজ বলে বিবেচিত।
৪. মানব জাতিকে মন্দ কাজসমূহ থেকে দূরে রাখা এবং সকল প্রকার গুপ্ত ও প্রকাশ্য পাপ ও অন্যায় থেকে বিরত রাখার জন্য প্রেরিত হয়েছি।
৫. আমার শরীয়তে অন্যায়ভাবে মানব হত্যা ও রক্তপাত ঘটানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মহান আল্লাহর নির্দেশ যাতে করে তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর।
৬. ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা হারাম।
৭. আমার ধর্মের ভিত্তি ন্যায়বিচার, এবং ওজনে কম দেয়া হারাম।
৮. আমরা কোন ব্যক্তিকে তার সাধ্য ও সামর্থ্যরে ঊর্ধ্বে দায়িত্ব ও কর্তব্য চাপিয়ে দেই না।
৯. মানুষের কথাবার্তা ও বক্তব্য-যা হচ্ছে তার সমগ্র মন-মানসিকতার আয়নাস্বরূপ তা সত্যের সমর্থনে ব্যবহৃত হওয়া আবশ্যক; আর সত্য ব্যতীত অন্য কিছু যেন মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত না হয়, এমনকি সত্য যদি তার ক্ষতিরও কারণ হয়।
১০. মহান আল্লাহর সাথে যে সব প্রতিজ্ঞা করেছ তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।


ছবিঃ পবিত্র কোরআন

এগুলো হচ্ছে তোমার স্রষ্টার বিধি-নিষেধ ও নির্দেশাবলী যা তোমরা অবশ্যই মেনে চলবে।

এ আয়াতদ্বয়ের অন্তর্নিহিত অর্থ এবং আসআদের সাথে মহানবীর আলোচনাপদ্ধতি থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এ সব হীন চারিত্রিক ত্রুটি অন্ধকার যুগের আরবদের আপাদমস্তক জুড়ে ছিল। আর এ কারণেই মহানবী (সা.) আসআদের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই এ দু’আয়াত তেলাওয়াত করে শুনিয়েছিলেন। আর এভাবে তিনি আসআদকে তাঁর রিসালাতের মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সম্পর্কে অবগত করেছিলেন।

চলবে...

পঠিত : ২৭৪৪ বার

মন্তব্য: ০