রানা প্লাজা ট্রাজেডিঃ রক্তমাখা মানুষগুলোর পাশে
তারিখঃ ২৪ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:২৭
আজ রানা প্লাজায় নিহতদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও আহতদের শোকের দিন। সেই দিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি এখনো তাদের কাঁদায়। এই দিনে অথাৎ ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সকাল ৮টা ৪৫মিনিটে রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামে ৯তলা ভবনটি মূর্হুতের মধ্যেই বিকট শব্দে প্রথম তলা বাদে বাকি সবগুলি তলা ধসে পড়ে। এতে এক হাজার ১৭৫ জন গার্মেন্টস শ্রমিক নিহত ও দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দূর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সেদিন এই শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকরাসহ সারা দেশের মানুষের চোখ ছিল টিভির পর্দার দিকে।
সবগুলো চ্যানেল ঐদিন ধংসস্তুপ থেকে উদ্ধার অভিযানের সচিত্র প্রতিবেদন সরাসরি সম্প্রচার করে। দেশবাসি দেখতে ও শুনতে পান ধংসস্তুপের নিচে চাপা পরে করুন মৃত্যুর দৃশ্য ও আটকে পড়াদের বাঁচার আকুতি ও আর্তনাতের আহজারি। গোটা দেশ ও জাতি ছিল স্তব্দ। নিহত ও আটকেপড়া আহতদের উদ্ধারে মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছেন কোটি কোটি মানুষ। সেদিন সাধারণ জনগণ, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে উদ্ধারকাজ চালায়। রানাপ্লাজা ধসের মাত্র পাঁচ মাস পূর্বে (২৪ নভেম্বর ২০১২) আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে ‘তাজরিন ফ্যাশন’ নামক একটি তৈরি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অকালে নিভে যায় ১১১টি জীবন প্রদীপ।
তবে সেদিনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি ছিল বলে জানাযায়। ১১১ জন নিহত শ্রমিকের শোক সইতে না সইতে এরপর রানাপ্লাজা ধসে এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিকের নিহতের ঘটনা সেদিন দেশের সর্ববৃহত্ত রপ্তানীযোগ্য প্রতিষ্ঠান গার্মেন্ট শিল্পের উপর নেমে আসে এক অনশনি সংকেত। উত্তেজিত পোশাক শ্রমিকরা দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবীতে ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যপক আন্দোলন ও ভাংচুর চালায়।
এই অবস্থা দেখে বিজিএমইএ দেশের সকল গার্মেন্টস সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। তাজরিন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ড ও রানাপ্লাজা ধস এই দু’টি ঘটনায় দেশের তৈরি পোষাক শিল্পের শ্রমিক অসন্তোষ আর ভয়াবহ রুপ ধারণ করে। বিদেশী ক্রেতাদের সংস্থা বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশের জিএসপি সুবিদা। বিশ্ব বাজারে একে একে হারাতে থাকে আমাদের অর্ডার। তবে রানাপ্লাজার ধসের ঘটনায় সরকার নড়ে চড়ে বসে।
সরকারসহ বিভিন্ন পক্ষ থেকে গামেন্টস কারখানার নিয়মনীতি আমূল পরির্বতনের জন্য ১০২টি উদ্যোগ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে রানা প্লাজার ঘটনার দিকে বিশেষ নজর দেয়। শক্ত হাতে ২৫ শে এপ্রিল ঢাকা উন্নয়ন কতৃপক্ষ ভবন ও ঐ ভবনের গার্মেন্টস মালিকদেরকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনায় দায়ীদেরকে দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন।
২৭শে এপ্রিল এই ভবনের দুটি গার্মেন্টসের মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া সাভার পৌরসভার দুজন প্রকৌশলীকেও গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হয়। ২৮শে এপ্রিল এই ঘটনায় দায়ী ভবন মালিক সাভার পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানাকে বেনাপোল সীমান্ত থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় র্যাব গ্রেপ্তার করে। রানাপ্লাজা ধসের পর এখনো পর্যন্ত এই শিল্পে বড় ধরনের কোন অঘটন ঘটেনি।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই গড়ে উঠা নয়তলা রানা প্লাজা ভবনটি তৈরীতে ছিল গলদ। ২০০৭ সালে রানা প্লাজা নির্মাণ করার আগে জায়গাটি ছিল পরিত্যক্ত ডোবা। ভবন নির্মাণ করার আগে বালু ফেলে এটি ভরাট করা হয়। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা গিয়েছিল যে ভবনের উপরের চার তলা অনুমতি ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছিল। ভবনটি শুরু থেকে শেষ পযন্ত মানা হয়নি রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ (রাজউক)’র নীতিমালা।
২৩ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে ফাটল নিশ্চিত হওয়ার পর ভবন ছেড়ে চলে যেতে বলা হচ্ছে সত্ত্বেও, অনেক গার্মেন্টস শ্রমিকদের পরের দিন কাজে ফিরতে বলা হয়, তাদের সুপারভাইজার ভবনটিকে নিরাপদ ঘোষণা করে। ফাটল সম্পর্কে স্থানীয় সংবাদ চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল। তারপর ও গামেন্টস কতৃপক্ষ ধরাকে সরাজ্ঞান মনে করে গামেন্টসে শ্রমিকদের আসতে বাধ্য করে। যার কারণে এতগুলি নিষ্পাপ জীবন ঝড়ে যায় তাদের অবহেলায়।
৫ বছর পূর্বের এই দিনে ধংসস্তুপের নিচে পড়ে নিহত ও আহত শ্রমিক ও তাদের পরিবারে মুছে গেছে অনাগত স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ। ভয়াবহ এই ধস কেড়ে নিয়েছে শত শত পরিবারের সুখ-শান্তি। ধংসস্তুপের নিচে চাপা পড়া শ্রমিক ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের করুন কান্নার আওয়াজ এখনো যেন কানে ভেসে আসে। আহতদের কথা কি আর বলব বেশির ভাগই শ্রমিকই পঙ্গুত্ব বরণ করে জীবনের বাকি দিনগুলো দূর্বিসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে ইতিমধ্যে খেয়ে না খেয়ে পাড় করছেন।
নানা বঞ্চনা ও শারিরীক অক্ষমতার সাক্ষী হয়ে রানাপ্লাজার আহতরা সাহায্যর জন্য মানুষের ধারে ধারে ঘুরেছে। কে তাদের সান্ত্বনা দেবে? এমন কেউ নেই পাশে। আছে শুধু আশ্বাস আর স্বপ্নের কথামালা। নিহত ও আহতদের বলছি, তোমরা আমাদের ক্ষমা করো। তোমাদের এই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তোমরা আছ বলে দেশ আজ বৈদেশিক মুদ্রায় ভরপুর। তোমাদের হাত দেশ গড়ার হাত। তোমাদের শ্রম ও ঘাম স্বর্নিভর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। তোমরা আছ বলে দেশ এগিয়ে চলছে।
আজও স্বজনদের আহাজারি কান পাতলে শোনা যায়। ট্রাজেডির ৫ বছরেও স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরতে পারেনি সেই রানা প্লাজার শ্রমিকরা। তাদের সংগ্রাম যেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সাথে। মানবেতর জীবন যাপন করছে আহত ও পঙ্গুত্ব বরণকারীরা। শারীরিক সমস্যা ছাড়াও মানসিক অনেক সমস্যায় পীড়িত হচ্ছে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের এই মানুষ গুলো।
প্রতি বছর এই দিনটি আসলে স্বজনহারা মানুষ গুলো প্ল্যাকার্ড আর ফুল নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মৃতি আজও খুজে ফিরে। দেশের অর্থনৈতিক এই কারিগরদের অসহায়ত্ব আজও দেখতে হয় আমাদের। দূর্ঘটনার ৩ বছরে পার হলেও নিখোঁজ ও আহত শ্রমিকদের সংখ্যা, তাদের দীর্ঘ বেকারত্বের সমাধান কেউ দিতে পারে নি। পারেনি তাদের ক্ষতিপূরণের সম্পূর্ণ টাকা প্রদান করতে। আজ পর্যন্ত বিশ্বের ইতিহাসে এই ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনার দোষীদের বিচার হয়নি।
গোলাপি বেগম, রাজ্জাক ও আমিনরা আজও যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। রহিমা তার মেয়ে রিমা আক্তারের ক্ষতিপূরণের জন্য আজও দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। ফেরদৌসি এখনো তার নিখোঁজ ছেলে মহিদুলের অপেক্ষায়। এ যেন শেষ হবার নয়। শোষিতের আর্তনাদ এর আজ ৫ বছর। আসুন আমরা এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াই। যেমনিভাবে ধসের প্রথম প্রহরে আমরা ছিলাম রক্তমাখা মানুষগুলোর পাশে।
‘‘মৃতদের স্মরণ করো, জীবিতদের জন্য লড়াই করো’’
মন্তব্য: ০