Alapon

ইসলাম পূর্ব আরবের অবস্থা (পর্ব-২)

জাহেলী আরব সমাজে নারীর মর্যাদা

কবি আবু তাম্মাম হাবিব ইবনে আওস কর্তৃক সংকলিত জাহেলিয়াত যুগের আরব কাব্য গ্রন্থের দশম অধ্যায় তদানীন্তন আরব সমাজে নারীর মর্যাদার প্রকৃত চিত্র উন্মোচন করার একটি উজ্জ্বল প্রামাণ্য দলিল। গ্রন্থটির এই অধ্যায় পাঠ করলে প্রতীয়মান হয় যে, আরব সমাজে নারী এক আশ্চর্যজনক বঞ্চনার শিকার ছিল এবং তারা বেদনাদায়ক জীবনযাপন করত। এ ছাড়াও জাহেলিয়াত যুগের আরবদের নিন্দায় পবিত্র কোরআনের যেসব আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে সেসব আয়াতে তাদের নৈতিক অধঃপতনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।



পবিত্র কোরআন কন্যাসন্তান হত্যা করার মতো আরবদের জঘন্য কাজকে ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছে : কিয়ামত দিবস এমনই এক দিবস যে দিবসে যে সব কন্যাসন্তানকে কবরে জীবন্ত পুঁতে হত্যা করা হয়েছে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সত্যিই মানুষ নৈতিকভাবে কতটা অধঃপতিত হলে তার নিজ কলিজার টুকরা সন্তানকে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর অথবা জন্মগ্রহণ করার পরই মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে পারে এবং সন্তানের বুকফাটা করুণ চিৎকারেও তার পাষাণ হৃদয় বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না!

সর্বপ্রথম যে গোত্রটি এ জঘন্য প্রথাটির প্রচলন করেছিল তারা ছিল বনি তামীম গোত্র। ইরাকের শাসনকর্তা নূমান বিন মুনযির বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বিদ্রোহী তামীম গোত্রের ওপর আক্রমণ চালিয়ে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। তামীম গোত্রের যাবতীয় ধন-সম্পদ জব্দ করা হয় এবং নারীদেরকে বন্দী করা হয়। তামীম গোত্রের প্রতিনিধিগণ নূমান বিন মুনযিরের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের নারী এবং কন্যাসন্তানদেরকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিয়ে ফেরত দেয়ার আবেদন করে।



কিন্তু বন্দিশালায় তামীম গোত্রের কতিপয় যুদ্ধ-বন্দিনীর বিবাহ হয়ে যাওয়ায় নূমান তাদেরকে তাদের পিতা ও পরিবারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করিয়ে স্বামীদের সাথে বসবাস অথবা স্বামীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কচ্ছেদ করে নিজেদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করার স্বাধীনতা দেয়। কাইস বিন আসেমের মেয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক অর্থাৎ স্বামীর সাথে বসবাস করাকে অগ্রাধিকার দিলে ঐ বৃদ্ধলোকটি অত্যন্ত ব্যথিত হয়। সে ছিল তামীম গোত্রের প্রেরিত প্রতিনিধিদের অন্যতম। সে এরপর প্রতিজ্ঞা করল যে, এখন থেকে সে তার কন্যাসন্তানদেরকে তাদের জীবনের ঊষালগ্নেই হত্যা করবে। ধীরে ধীরে এ জঘন্য প্রথা অনেক গোত্রের মধ্যেই প্রচলিত হয়ে যায়।

কাইস বিন আসেম যখন মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়েছিল তখন একজন আনসার সাহাবী তাকে তার মেয়েদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিল। কাইস জবাবে বলেছিল, “আমি আমার সকল কন্যাসন্তানকে জীবন্ত দাফন করেছি, কেবল একবার ব্যতীত। আর কখনই এ কাজ করতে গিয়ে আমি একটুও কষ্ট পাই নি। আর সেটি ছিল : একবার আমি সফরে ছিলাম। আমার স্ত্রীর সন্তান প্রসবকাল অতি নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছিল। দৈবক্রমে আমার সফর বেশ দীর্ঘায়িত হলো। সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আমি আমার স্ত্রীকে সন্তান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম।



সে আমাকে বলল : কোন কারণে সে মৃত সন্তান প্রসব করেছে। আসলে সে একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেছিল, কিন্তু সে আমার ভয়ে ঐ কন্যাসন্তানকে জন্মের পর পরই তার বোনদের কাছে রেখেছিল। অনেক বছর কেটে গেলে ঐ মেয়েটি যৌবনে পা দিল, অথচ তখনও আমি জানতাম না যে, আমার একটি মেয়ে আছে। একদিন আমি আমার ঘরে বসে আছি, হঠাৎ একটি মেয়ে ঘরে প্রবেশ করে তার মাকে খোঁজ করতে লাগল। ঐ মেয়েটি ছিল সুন্দরী। তার চুলগুলো বেনী করা ছিল এবং তার গলায় ছিল একটি হার।

আমি আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই মেয়েটি কে? তখন তার নয়নযুগল অশ্রুজলে পূর্ণ হয়ে গেল এবং সে বলল : এ তোমার ঐ মেয়ে যখন তুমি সফরে ছিলে তখন তার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু আমি তোমার ভয়ে তাকে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমার স্ত্রীর এ কথায় আমার নীরব থাকার বিষয়টি এতে আমার সন্তুষ্টি ও মৌন সম্মতি বলেই সে মনে করল। সে ভাবল যে, আমি এ মেয়েকে হত্যা করব না।

এ কারণেই আমার স্ত্রী একদিন নিশ্চিন্ত মনে ঘর থেকে বাইরে গেল। আর আমিও যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তা পালন করার জন্য আমার মেয়েকে হাত ধরে দূরবর্তী একটি স্থানে নিয়ে গেলাম। সেখানে আমি একটি গর্ত খুঁড়তে লাগলাম। গর্ত খোঁড়ার সময় সে আমাকে বার বার জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন আমি এ গর্ত খনন করছি? খনন শেষে আমি তার হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে গর্তের ভিতরে ফেলে দিলাম এবং তার দেহের ওপর মাটি ফেলতে লাগলাম। তার করুণ আর্তনাদের প্রতি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করলাম না। সে কেঁদেই যাচ্ছিল এবং বলছিল : বাবা! আমাকে মাটির নিচে চাপা দিয়ে এখানে একাকী রেখে আমার মায়ের কাছে ফিরে যাবে?

আমি তার ওপর মাটি ফেলেই যাচ্ছিলাম এবং তাকে সম্পূর্ণরূপে মাটির মধ্যে জীবন্ত পুঁতেই ফেললাম। হ্যাঁ, কেবল এই একবারই আমার হৃদয় কেঁদেছিল-আমার অন্তর জ্বলে-পুড়ে গিয়েছিল।” কাইসের কথা শেষ হলে মহানবী (সা.)-এর দু’চোখ অশ্রুজলে ভরে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, “এটি পাষাণ হৃদয়ের কাজ। যে জাতির দয়া-মায়া নেই সে জাতি কখনই মহান আল্লাহর দয়া ও করুণা লাভ করতে পারে না।



আরব সমাজে নারীদেরকে পণ্যের মতো কেনা-বেচা করা হতো। তারা সব ধরনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার, এমনকি উত্তরাধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। আরব বুদ্ধিজীবীরা নারীদেরকে পশু বলে মনে করত। আর এ কারণেই তাদেরকে দৈনন্দিন জীবনের পণ্য-সামগ্রী ও আসবাবপত্রের মধ্যে গণ্য করা হতো। এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই و إنّما أمّهات النّاس أوعية ‘মায়েরা ঘটি-বাটি ও থালা-বাসনের মতো’-এ প্রবাদ বাক্যটি আরবদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল।

প্রধানত দুর্ভিক্ষের ভয়ে এবং কখনো কখনো কলুষতা ও অশূচিতার ভয়ে আরবরা মেয়েদেরকে জন্মগ্রহণের পর পরই হত্যা করে ফেলত। কখনো পাহাড়ের ওপরে তুলে সেখান থেকে নিচে ফেলে দিত এবং কখনো কখনো পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করত। আমাদের মহান ঐশী গ্রন্থ যা অমুসলিম প্রাচ্যবিদদের দৃষ্টিতে ন্যূনপক্ষে একটি অবিকৃত ঐতিহাসিক তাত্ত্বিক গ্রন্থ যা এতৎসংক্রান্ত একটি অভিনব কাহিনী বর্ণনা করেছে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন তাদের কোন এক ব্যক্তিকে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণের সুসংবাদ দেয়া হতো তখন তার বর্ণ কালো হয়ে যেত এবং বাহ্যত সে যেন তার ক্রোধকে চাপা দিত। আর এই জঘন্য সংবাদ শোনার কারণে সে (লজ্জায়) তার সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াত। আর সে জানত না যে, সে কি অপমান ও লাঞ্ছনা সহকারে তার এ নবজাতক কন্যাসন্তান প্রতিপালন করবে, নাকি তাকে মাটির নিচে জীবন্ত পুঁতে ফেলবে? সত্যিই তাদের ফয়সালা কতই না জঘন্য!”



সবচেয়ে দুঃখজনক ছিল আরবদের বৈবাহিক ব্যবস্থা। পৃথিবীতে এর কোন নজির বিদ্যমান নেই। যেমন আরবদের কাছে স্ত্রীর কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল না। স্ত্রীর মোহরানা যাতে আদায় করতে না হয় সেজন্য তারা স্ত্রীদেরকে নির্যাতন ও উৎপীড়ন করত। কোন মহিলা চারিত্রিক সততার পরিপন্থী কোন কাজ করলেই তার মোহরানা সম্পূর্ণরূপে বাতিল হয়ে যেত। কখনো কখনো আরবরা এ নিয়মের অপব্যবহার করত। মোহরানা যাতে আদায় করতে না হয় সেজন্য তারা নিজেদের স্ত্রীদের ওপর অপবাদ আরোপ করত। পুত্রসন্তানগণ পিতার মৃত্যুর পর বা পিতা তালাক দিলে পিতার স্ত্রীদেরকে নিজের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে পারত এবং এতে কোন অসুবিধা ছিল না।

যখন মহিলা তার স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্তা হতো তখন প্রাক্তন তথা প্রথম স্বামীর অনুমতির ওপর তার পুনর্বিবাহ নির্ভর করত। আর কেবল অর্থ প্রদানের মাধ্যমেই প্রথম স্বামীর অনুমতি পাওয়া যেত। উত্তরাধিকারিগণ ঘরের আসবাবপত্রের মতো উত্তরাধিকারসূত্রে মহিলাদের (পিতার স্ত্রীদের) মালিক হতো এবং তাদের মাথার ওপর রোসারী (Scarf) নিক্ষেপ করে উত্তরাধিকারিগণ তাদের নিজ নিজ স্বত্বাধিকার ঘোষণা করত। 

আরবের ধর্মীয় অবস্থা

যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) তাওহীদের পতাকা হিজায অঞ্চলে উড্ডীন এবং পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর সহায়তায় পবিত্র কাবা পুনঃর্নিমাণ করলেন তখন একদল লোক তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিল এবং তাঁর বরকতময় পবিত্র অস্তিত্বের আলোক প্রভায় অনেক মানুষের অন্তর আলোকিত হয়েছিল। তবে সঠিকভাবে জানা যায় নি যে, স্বর্গীয় ব্যক্তিত্ব হযরত ইবরাহীম (আ.) কতদূর ও কি পরিমাণ তাওহীদী ধর্ম ও মতাদর্শ প্রচার এবং সেখানে তাওহীদবাদী পূজারীদের দৃঢ় সমাজ গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হযরত আলী (আ.) আরব জাতি ও গোত্রসমূহের ধর্মীয় অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন :

و أهل الأرض يومئذ ملل متفرّقة و الهواء منتشرة و طوائف متشتّتة بين مشبّه لله بخلقه أو ملحد في اسمه أو مشير إلى غيره فهداهم به من الضّلالة و انقذهم من الجهالة



“তখন (অন্ধকার যুগে) আরব জাতি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিদআত (ধর্ম বহির্ভূত প্রথা) প্রচলিত ছিল এবং তারা বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। একদল লোক মহান আল্লাহ্কে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করত (এবং মহান আল্লাহর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত)। কেউ কেউ মহান আল্লাহর নামের ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করত [যেমন মূর্তিপূজকরা লাত (لات) মূর্তির নাম ‘আল্লাহ্’ শব্দ থেকে এবং প্রতিমা উয্যার (عزّى) নাম নবী ‘উযাইর’ (عزير) থেকে নিয়েছিল]। আবার কতিপয় ব্যক্তি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সত্তার দিকে ইশারা-ইঙ্গিত করত; অতঃপর এদের সবাইকে আল্লাহ্ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে সৎ পথের সন্ধান দিলেন-সৎ পথে পরিচালিত করলেন এবং তাদেরকে পথভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা থেকে মুক্তি দিলেন।”



আরবের চিন্তাশীল শ্রেণীও চাঁদের উপাসনা করত। আরবের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক কালবী (মৃত্যু ২০৬ হি.) লিখেছেন : বনি মালীহ্ গোত্র (بني مليح) জ্বিনপূজারী ছিল। হিময়ার গোত্র  (حمير) সূর্য, কিনানাহ্ গোত্র  (كنانة) চাঁদ, তামীম গোত্র (تميم) আলদেবারান (Al-debaran), লাখম গোত্র (لخم) বৃহস্পতি, তাই গোত্র (طي) শুকতারা, কাইস গোত্র  (قيس)শে’রা নক্ষত্র (Dog star) এবং আসাদ গোত্র (أسد)বুধ গ্রহের পূজা করত।

কিন্তু নিম্নশ্রেণীর লোক যারা আরবের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তারা তাদের গোত্রীয় ও পারিবারিক প্রতিমা ছাড়াও বছরের দিবসসমূহের সংখ্যা অনুসারে ৩৬০টি মূর্তির পূজা করত এবং প্রতিদিনের ঘটনাসমূহকে ঐ ৩৬০টি মূর্তির যে কোন একটির সাথে জড়িত বলে বিশ্বাস করত।

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পরে আমর বিন কুসাই-এর দ্বারা মক্কায় মূর্তিপূজার প্রচলন হয়েছিল। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, শুরুতে তা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল না; বরং প্রথম দিকে আরবগণ মূর্তিগুলোকে সুপারিশকারী বলে বিশ্বাস করত। এরপর তারা আরো এক ধাপ এগিয়ে এ সব প্রতিমাকে খোদায়ী শক্তির অধিকারী বলে ভাবতে থাকে। যে সব মূর্তি পবিত্র কাবার চারপাশে স্থাপিত ছিল সেগুলো আরবের সকল গোত্রের শ্রদ্ধাভাজন ও আরাধ্য ছিল। তবে গোত্রীয় প্রতিমাসমূহ ছিল কেবল নির্দিষ্ট কোন গোত্র বা দলের কাছেই শ্রদ্ধাভাজন ও পূজনীয়। প্রতিটি গোত্রের প্রতিমা ও মূর্তি যাতে সংরক্ষিত থাকে সেজন্য তারা প্রতিমাসমূহের জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করত। মন্দিরসমূহের তদারকির দায়িত্ব উত্তরাধিকারসূত্রে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে স্থানান্তর হতো।



পারিবারিক প্রতিমা ও মূর্তিসমূহের পূজা প্রতি দিন-রাত একটি পরিবারের মধ্যে সম্পন্ন হতো। ভ্রমণে যাওয়ার সময় তারা নিজেদের দেহকে পারিবারিক প্রতিমাসমূহের সাথে রগড়াতো। ভ্রমণ অবস্থায় তারা মরুভূমির পাথরসমূহের পূজা করত। যে স্থানেই তারা অবতরণ করত সেখানে চারটি পাথর বাছাই করে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরটিকে নিজের উপাস্য এবং অবশিষ্ট পাথরগুলোকে বেদীর পদমূল হিসাবে গণ্য করত।

মক্কার অধিবাসীদের হারাম শরীফের প্রতি চরম আকর্ষণ ছিল। ভ্রমণের সময় তারা হারামের পাথর সাথে নিয়ে যেত এবং যে স্থানেই তারা যাত্রাবিরতি করত সেখানে তা স্থাপন করে পূজা করত। সম্ভবত এগুলোই ‘আনসাব’(أنصاب) হতে পারে যেগুলোকে মসৃণ ও অবয়বহীন পাথর হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এগুলোর বরাবরে আছে ‘আওসান’(أوثان) যার অর্থ হচ্ছে আকার-আকৃতি ও নকশাবিশিষ্ট এবং চেঁচে ফেলা হয়েছে এমন পাথর। ‘আসনাম’(أصنام) হচ্ছে ঐ সকল প্রতিমা যা স্বর্ণ ও রৌপ্যকে গলিয়ে অথবা কাঠ খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে।



মূর্তিসমূহের সামনে আরবদের বিনয়াবনত হওয়া আসলে মোটেও আশ্চর্যজনক বিষয় নয়। আরবগণ বিশ্বাস করত যে, কোরবানী করার মাধ্যমে এ সব মূর্তির সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। কোরবানী করার পর তারা কোরবানীকৃত পশুর রক্ত প্রতিমার মাথা ও মুখমণ্ডলে মর্দন করত। গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহের ক্ষেত্রে তারা এ সব প্রতিমার সাথে পরামর্শ করত। তারা পরামর্শের জন্য কতগুলো কাঠ (লাঠি) ব্যবহার করত। এগুলোর একটিতে লেখা থাকত إفعل অর্থাৎ কর; অন্যটিতে লেখা থাকত لا تفعل (করো না)। এরপর তারা হাত বাড়িয়ে দিত, অতঃপর যে লাঠিটি বেরিয়ে আসত তাতে যা লেখা থাকত তদনুসারে তারা কাজ করত।

আরব জীবনের  চিত্র

আরবদের ঐ সকল স্বভাব-চরিত্র এবং সামাজিক রীতি-নীতি তুলে ধরাই এখানে লক্ষ্য যা ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এ সব রীতি-নীতির মধ্যে বেশ কিছু রীতি গোটা আরব জাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। সার্বিকভাবে আরবদের সাধারণ এবং প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য নিম্নোক্ত কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে বর্ণনা করা যেতে পারে :

জাহেলীয়াতের যুগে আরবগণ, বিশেষ করে আদনানের বংশধরগণ স্বভাবতঃই দানশীল ও অতিথিপরায়ণ ছিল। তারা কদাচিৎ আমানতের খিয়ানত করত। তারা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করাকে ক্ষমার অযোগ্য পাপ বলে গণ্য করত। তারা আকীদা-বিশ্বাসের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করত না। তারা স্পষ্টভাষী ছিল। তাদের মাঝে শক্তিশালী ধী ও স্মরণশক্তিসম্পন্ন এমন ব্যক্তিবর্গ ছিল যারা আরবের কবিতা এবং বক্তৃতাসমূহ কণ্ঠস্থ করে রেখেছিল। আরবগণ কাব্যচর্চা এবং বক্তৃতায় সে যুগে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিল। তাদের সাহস প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। তারা অশ্বচালনা এবং তীর নিক্ষেপে সিদ্ধহস্ত ছিল। পলায়ন এবং শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শনকে তারা মন্দ ও গর্হিত কাজ বলে বিবেচনা করত।



এ সব গুণের পাশাপাশি অনেক চারিত্রিক দোষ তাদেরকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছিল যে, তাদের সব ধরনের মানবীয় পূর্ণতার দীপ্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আর অদৃশ্যলোক থেকে যদি তাদের ওপর করুণা ও দয়ার বাতায়ন উন্মুক্ত করা না হতো তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হতো। আপনারা বর্তমানে কোন আদনানী আরবের অস্তিত্বই খুঁজে পেতেন না এবং অতীতের বিলুপ্ত আরব গোত্রসমূহের কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি হতো।



একদিকে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ও সঠিক কৃষ্টি-সংস্কৃতির অনুপস্থিতি এবং অন্যদিকে চরিত্রহীনতা ও কুসংস্কারের ব্যাপক প্রসারের কারণে আরব জাতির জীবন মানবেতর জীবনে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসের পাতা আরবদের পঞ্চাশ বছর ও একশ’ বছর স্থায়ী যুদ্ধের কাহিনী ও বিবরণে পূর্ণ। এ সব যুদ্ধ তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছে। বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করতে সক্ষম কোন শক্তিশালী সরকার ও প্রশাসন না থাকার কারণে আরব জাতি যাযাবর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল।



এর ফলে তারা প্রতি বছর তাদের পশু ও অশ্বসমেত মরুভূমিতে এমন সব এলাকার সন্ধানে ঘুরে বেড়াত যেখানে প্রচুর পানি ও লতাগুল্মের অস্তিত্ব আছে। এ কারণে যেখানেই তারা পানি ও বসতির নিদর্শন দেখতে পেত সেখানেই অবতরণ করে তাঁবু স্থাপন করত। আর যখনই অধিকতর উত্তম কোন স্থানের সন্ধান পেত তখনই সেখানে যাওয়ার জন্য মরুপ্রান্তর পাড়ি দিত।

তাদের এ যাযাবর জীবনের পেছনে দু’টি কারণ রয়েছে : ১. পানি, জলবায়ু-আবহাওয়া এবং চারণভূমির দিক থেকে আরবের খারাপ ও প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থা এবং ২. প্রচুর রক্তপাত ও হানাহানি যা তাদেরকে ভ্রমণ ও এক জায়গা ত্যাগ করে অন্যত্র গমন করতে বাধ্য করত।

মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আরবদের চিন্তা

আরবরা এই দার্শনিক সমস্যাকে ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছে : মানবাত্মা মৃত্যুর পর পেঁচাসদৃশ একটি পাখির আকৃতিতে দেহ থেকে বের হয়ে আসে যার নাম ‘হামা’(هامَة) ও ‘সাদা’ (صَدَى)। এরপর তা মানুষের নিস্প্রাণ দেহের পাশে অনবরত অত্যন্ত করুণ স্বরে ও ভয়ঙ্করভাবে কাঁদতে থাকে। যখন মৃতের আত্মীয়-স্বজনরা ঐ মরদেহকে কবরে শায়িত করে তখন যেভাবে বলা হয়েছে ঠিক সেভাবে তার আত্মা তার সমাধিস্থলে আবাসন গ্রহণ করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। কখনো কখনো সন্তান ও বংশধরদের অবস্থা জানার জন্য তাদের ঘরের ছাদে এসে বসে।



মানুষ যদি অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে তাহলে উক্ত প্রাণীটি (অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণকারী মানুষের আত্মা যা পেঁচাসদৃশ পাখির আকৃতি ধারণ করেছে) অনবরত চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আমাকে পান করাও, আমাকে পান করাও’ অর্থাৎ আমার হত্যাকারীর রক্তপাত করে আমার তৃষ্ণা নিবারণ কর। আর যতক্ষণ পর্যন্ত হত্যাকারী থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তা নীরব হবে না। ঠিক এভাবে সম্মানিত পাঠকবর্গের কাছে প্রকৃত অবস্থা পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং তাঁরা অবগত হতে পারবেন যে, প্রাক-ইসলাম যুগে আরব জাতির ইতিহাস এবং ইসলামোত্তর আরব জাতির ইতিহাস আসলে দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন ইতিহাস।

কারণ প্রাক-ইসলাম অর্থাৎ অন্ধকার যুগে আরবগণ কন্যাসন্তানকে হত্যা করত এবং তাদেরকে জীবন্ত কবর দিত। অনাথ শিশুদেরকে দয়া-মায়া দেখানো হতো না। লুটতরাজ করা হতো এবং কাঠ ও পাথরের প্রতিমাসমূহের পূজা করা হতো। তখন এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র চিন্তা-ভাবনা করা হতো না। (অথচ ইসলামোত্তর যুগে এ সব কুসংস্কার ও কুপ্রথা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পরে আরব জাতির ইতিহাস প্রাক-ইসলাম যুগের আরব জাতির ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা)।
 
সমাপ্ত

পঠিত : ১৯৩০ বার

মন্তব্য: ০