Alapon

ট্রোজান হর্স ও ঐতিহাসিক ট্রয় নগরী ধ্বংসের কাহিনী

যে যুদ্ধে ধ্বংস হয় ট্রয় নগরীঃ



ঐতিহাসিক ট্রয়ের যুদ্ধ নিয়ে অনেক কল্প-কাহিনী শুনতে পাওয়া যায়। বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখনিতেও উঠে আসে ট্রয় যুদ্ধ লোমহর্ষক বর্ণানা। আপনারা নিশ্চয়ই মহাকবি হোমারের নাম শুনেছেন। তার দুটো মহাকাব্য ইলিয়াড এবং ওডিসির কারনে এই রোমান্টিক ট্রয়ের ট্র্যাজেডি অমর হয়ে আছে। এরপর আরও অনেক বিখ্যাত কবি ট্রয়ের যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন। এদের মধ্যে আছেন গ্রিক কবি হেরোডোটাস, সোফোক্লেস এবং রোমান কবি ভার্জিল আর ওভিড।

এই কাহিনি এতোটাই চমকপ্রদ এবং রোমাঞ্চকর যে, গ্রিক সাহিত্য এবং রোমান সাহিত্যের একটা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে ট্রয়ের যুদ্ধ। তাদের এসব লেখার মধ্যমেই আমরা জানতে পারি হেলেন, প্যারিস, অ্যাকিলিস, হেক্টর, আগামেমনন, অডিসিয়াস এবং অ্যাজাক্সের মত ট্রয়ের যুদ্ধের সাথে জড়িত অন্যান্য চরিত্রগুলো সম্পর্কে কাহিনি।

ঐতিহাসিক ট্রয় নগরীর রাজা ছিলেন প্রিয়াম এবং রাণীর নাম ছিল হেকবা। তাদের আদরের পুত্রের নাম ছিল প্যারিস। এই প্যারিসই ছিল মুলত ত্রয় যুদ্ধের পেছনের মুল হোতা। রাজপুত্র প্যারিস, গ্রিসের স্পার্টা রাজ্য-শহরের রাজা মেনেলাস-এর স্ত্রী হেলেনকে নিয়ে ট্রয়ে পালিয়ে আসেন আর সেই থেকে এই যুদ্ধের শুরু।  

ট্রয় যুদ্ধের কারন কি এটাই ছিলো?



ট্রয়ের যুদ্ধের কারন নিয়ে বিভিন্ন মিথ চালু রয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন, গ্রিক পুরানে আছে – পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো বলে দেবরাজ যিউস চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন জনসংখ্যা কমিয়ে আনতে। আর এজন্য যুদ্ধ সৃষ্টি করার মতো একটা পরিকল্পনা তার মাথায় আসে।

আরেকটি ঘটনা কথিত আছে- আগেই বলেছি ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস আর স্পার্টা রাজ্যের রানি হেলেনের কথা, প্যারিস হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথাও জানি আমরা। কিন্তু প্রশ্ন হল কীভাবে প্যারিস হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্ররোচনা পেল? একজন রাজার প্রাসাদ থেকে রাণীকে নিয়ে পালানো তো চাট্টিখানি কথা নয়! তাছাড়া এটা কোনো জোরপূর্বক অপহরণের ঘটনাও ছিল না। রানি নিজেই প্যারিসের জাত ধরে বাসা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। কিন্তুই কেনইবা তিনি এটা করলেন? কেনই বা লাগলো এই যুদ্ধ। তাহলে কেন এই যুদ্ধ লাগলো?

বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন – প্যারিস আর হেলেন পরস্পরকে ভালোবাসতো। তাই স্বামী মেনেলাস আর স্পার্টার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে ট্রয় নগরীর রাজপুত্রের সাথে পালিয়ে যেতে বাধেনি হেলেনের। কিন্তু রাণী আরেকজনের হাত ধরে পালিয়ে যাবে, আর রাজা বসে বসে আঙুল চুষবে? না না! তাই মেনেলাস তার সমস্ত শক্তি নিয়ে  ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পরলেন। 

নিশ্চই প্রশ্ন জাগছে কিভাবে হেলেন ও প্যারিসের মদ্ধে ভালবাসা হয়েছিল আর কিভাবে তারা পালিয়ে যাওয়ার সাহস পেল? এবার আসছি সেই ঘটনায়।

ট্রয় যুদ্ধের পেছনের ইতিহাসঃ

ট্রয়ের যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিলো তিনজন গ্রিক দেবীর মধ্যে ঝগড়ার কারণে। দেবী তিনজন হলেন এথেনা, হেরা এবং আফ্রোদিতি। ইনাদের মধ্যে আবার ঝগড়া লাগিয়েছিলেন আরেক দেবী “এরিস”। ঝগড়া বাঁধানোর কারণটাও যুক্তিযুক্ত – এরিস হলেন ঝগড়া আর বিশৃঙ্খলার দেবী!

তিনি একটা সোনালী আপেল দিয়েছিলেন এই তিন দেবীকে, যাকে মাঝে মধ্যে “বিশৃঙ্খলার আপেল” হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং যার গায়ে খোদাই করা ছিল এই বাক্যটি – “শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর জন্য”। ফলে তিনজন দেবীর প্রত্যেকেই নিজেকে এই আপেলের দাবীদার বলতে লাগলেন। দেবতারা কেউ তিন দেবীর রূপ বিচারের সাহস পেলেন না। বাধ্য হয়ে যিউস সুন্দরীতমা নির্বাচনের ভার দিলেন প্যারিসকে, যিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন মানুষ।

প্যারিস আফ্রোদিতিকে সবচেয়ে সুন্দরী বললেন এবং বিনিময়ে উপহার হিসেবে আফ্রোদিতির কাছ থেকে পেলেন জগতের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর ভালোবাসা। সে সময় সবচেয়ে সুন্দরী মানবী ছিলেন হেলেন, যিনি ছিলেন আবার স্পার্টার রাজা মেনেলাসের স্ত্রী। আফ্রোদিতির কারুকাজে হেলেন মনপ্রাণ সঁপে দিলেন প্যারিসকে এবং দুজনে মিলে পালিয়ে এলেন ট্রয়ে।

রানি হেলেন পালিয়ে যাওয়ার পরে মেনেলাসের বুকে জ্বলছিল ক্রোধের আগুন। মেনেলাস তার ভাই মাইসিন রাজ্যের রাজা আগামেমননকে আহ্বান করলেন তার পক্ষে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। ভাইয়ের স্ত্রিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আগামেমনন তার অ্যাশিয়ান্স দল নিয়ে রওনা দিলেন ট্রয়ের উদ্দেশ্যে। প্রায় দশ বছর ধরে আগামেমননের সৈন্যবাহিনী চারদিক দিয়ে ট্রয় নগরীকে ঘিরে রাখলো। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে মারা গেলেন অ্যাশিয়ান্স বীর অ্যাকিলিস, অ্যাজাক্স এবং ট্রোজান বীর প্যারিস ও তার ভাই হেক্টর। কিন্তু দুই পক্ষ ছিল শক্তিতে সমান ফলে যুদ্ধে কারো জয় বা পরাজয় হল না। এর পরই ঘটলো সেই ট্রোজান হর্স নামক বিশাল আক্রিতির কাথের ঘোড়ার ঘটনা।

ট্রোজান হর্সঃ



দশ বছরের চেষ্টার পরও যুদ্ধে জয়লাভ করতে না পেরে গ্রিক যোদ্ধারা এক চাতুরির আশ্রয় নিল। এই চাতুরির নামই হচ্ছে ট্রোজান হর্স। তারা সবার অজান্তে কালো রঙের বিশাল আকৃতির এক ঘোড়া এনে ট্রয় নগরির সম্মুখে রেখে গেল। ট্রয়ের মানুষজন মনে করলো স্পারটানরা যুদ্ধে হার মেনে নিয়েছে আর উপহার হিসেবে এই ঘোড়া রেখে গেছে। তারা  কিছু না বুঝে এই ঘোড়াটিকে ট্রয় নগরীর ভেতরে নিয়ে আসলো। আর এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ভুল।

মাঝরাতে যখন ট্রয়ের বাসিন্দারা ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন এই কাঠের ঘোড়া খুলে গেল। আর ভেতর থেকে ঝাকে ঝাকে বেরিয়ে এল স্পারটান ও অ্যাশিয়ান্স যোদ্ধারা। নগরে ঢুকার পর অ্যাশিয়ান্সরা সামনে যাকে পেলো, তাকেই জবাই করা শুরু করলো। শুধুমাত্র কয়েকজন শিশু আর মহিলা রক্ষা পেলো, যাদেরকে পরে দাসদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিলো। তারা ট্রয়ের মন্দিরগুলো নোংরা কাজে ব্যবহার করে দূষিত করে ফেললো। তবে তারা বুঝতে পারেনি যে, এই কারণে দেবতাদের জিঘাংসা নেমে আসবে তাদের উপর।

যুদ্ধ শেষে কয়েকজন অ্যাশিয়ান্স নিজ দেশে ফিরে এসেছিলো, এবং অনেকে এজিয়ান সাগর তীরে বাসা বেঁধেছিলো। ধীরে ধীরে তারা সেখানে নিজেদের কলোনি তৈরি করলো।

ট্রয়ের যুদ্ধ কি কল্পকাহিনী নাকি সত্যিই ইতিহাস?

১৮৬৮ সালে হেইনরিখ শ্লিম্যান এবং ফ্র্যাঙ্ক ক্যাল্ভার্ট নামক দুজন প্রত্নতাত্ত্বিক তুরস্কের হিসার্লিক অঞ্চলে এক প্রাচিন নগরীর সন্ধান পান। নগরীর ধ্বংসাবশেষ থেকে যা কিছু উদ্ধার করা গেছে তা থেকে গবেষকরা আবিষ্কার করেন এটাই সেই গ্রিক পুরানে বর্ণিত ট্রয় নগরি। আর এই ঘটনার পর থেকেই সবাই  আবার নতুন করে ট্রয়ের যুদ্ধের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করে। কিন্তু প্রাচীনকালের গ্রিসবাসীরা বিশ্বাস করতেন, ট্রয়ের যুদ্ধ একটা ঐতিহাসিক সত্য কাহিনি। তারা ভাবতেন, ঘটনাটি ঘটেছিলো খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ বা ১২০০ সালে। তবে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে বেশিরভাগ মানুষই এই বিশ্বাস থেকে সরে এসেছিলেন। তারা ভাবতেন, ট্রয় নগরী বা ট্রয়ের যুদ্ধ – উভয় বিষয়ই নিছক গল্পগাঁথা।

পঠিত : ২৩৯৯ বার

মন্তব্য: ০