Alapon

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অভিশপ্ত ইহুদী জাতি (পর্ব-১)

ইহুদী জাতি নিজেদের আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত জাতি হিসাবে গণ্য করে, নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, অন্যান্য জাতিকে হীন বলে গণ্য করে । অথচ তাদের মধ্যে জগতের সকল নিকৃষ্ট ও জঘন্য কার্যকলাপ বিদ্যমান । তারা সেই আদিকাল থেকেই পৃথিবীর বুকে নানান অশান্তি, যুদ্ধ - বিগ্রহ বাধঁতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।

ইহুদী এমন একটি জাতি যাদের নামের সাথে জড়িয়ে আছে বহু সংখ্যক নবী ও রাসুল হত্যার ইতিহাস। তারা হযরত ইয়াহিয়া (আ.) কে হত্যা করেছিল, হযরত যাকারিয়া (আ.) কে করাত দিয়ে চিরে দুই টিকরা করে ফেলেছিল, ইউসুফ (আ.) কেও হত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি।

ইহুদীরা পবিত্র ও সতী-সাধ্বী নারী হযরত মরিয়ম (সা.)'র ওপর ব্যাভিচারের জঘন্য অপবাদ আরোপ করেছিল। তারা এ অপবাদ রটিয়ে হযরত ঈসা (আ.)কে মরিয়মের ব্যভিচারের ফসল হিসেবে তুলে ধরে এবং এর মাধ্যমে এটা দেখাতে চেয়েছে যে, ঈসা (আ.) নবী বা পথ-প্রদর্শক হওয়ার উপযুক্ত নন। আর এ অপবাদের ভিত্তিতেই ইহুদীরা ঈসা (আ.) কে রাসূল হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। তারা হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে এমন জঘন্য অপবাদ প্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি, এমনকি তাঁকে হত্যারও ষড়যন্ত্র করে।

ইহুদী ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে হত্যা করতে পেরেছিল বলেও এক ধরনের ধাঁধা বা ভুল ধারণার শিকার হয়। আর ওই হত্যাকাণ্ডের ভিত্তিতে অত্যন্ত দম্ভ ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তারা বলেছিল, আমরাই ঈসাকে হত্যা করেছি। কিন্তু মহান আল্লাহ কোরআনে বলছেন যে, আসলে তারা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল যে ছিল দেখতে ঈসার মত এবং তারা ধোঁকা বা সন্দেহের শিকার হয়েই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

সূরা নিসার ১৫৬ থেকে ১৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَبِكُفْرِهِمْ وَقَوْلِهِمْ عَلَى مَرْيَمَ بُهْتَانًا عَظِيمًا (১৫৬) وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا (১৫৭) بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا ((১৫৮

"আর তাদের কুফরী এবং মরিয়মের প্রতি মহা অপবাদ আরোপ করার কারণে (তারা আল্লাহর ক্রোধ বা অভিশাপের পাত্র হয়েছিল)।" (৪:১৫৬)

"আর তাদের একথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধার শিকার হয়ে (দেখতে ঈসার মত এক ব্যক্তিকে হত্যা করে) ছিল। বস্তুতঃ তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি।" (৪:১৫৭)

এ লিখায় হযরত মূসা (আ.)-এর যুগ থেকে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগ পর্যন্ত ইহুদী জাতির একটি সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা সংক্ষিপ্তাকারে চিত্রিত করতে চেষ্টা করবো । আমরা ‘নিকট প্রাচ্যের গীর্জাসমূহের সংঘ’ কর্তৃক প্রকাশিত পবিত্র বাইবেল বা ‘কিতাব-ই মুকাদ্দাসের অভিধান’ নামক গ্রন্থ এবং মরহুম মুহাম্মদ ইয্যাত দ্রুযেহ প্রণীত ‘ইহুদীদের গ্রন্থসমূহের ভিত্তিতে তাদের ইতিহাস’- এ দু’গ্রন্থের ভিত্তিতে আমরা তাদের এ ইতিহাস তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।
এ দীর্ঘ সময়ে ইহুদী জাতির ইতিহাস দশ পর্যায়ে বিভক্ত। যথা-

১. হযরত মূসা (আ.) ও ইউশা (আ.)-এর যুগ ( খ্রি.পূ. ১২৭০-১১৩০)
২. হযরত দাউদ ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর যুগ (খ্রি.পূ. ১০২৫-৯৩১)
৩. বিচারকদের যুগ (খ্রি.পূ. ১১১০-১০২৫)
৪. অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যুগ (খ্রি.পূ. ৯০১-৮৫৯)
৫. আশুরীয়দের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ (খ্রি.পূ. ৮৫৯-৬১১)
৬. ব্যাবিলনীয়দের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের যুগ (খ্রি.পূ. ৫৯৭-৬১১)
৭. ইরানীদের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ (খ্রি. পূ. ৫৩৯-৩৩১)
৮. গ্রীকদের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ (খ্রি.পূ. ৩৩১-৬৪)
৯. রোমীয়দের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ (খ্রি.পূ. ৬৪-৬১৮ খ্রি.)
১০. ইসলাম ও মুসলমানদের শাসন কর্তৃত্বের যুগ (খ্রি. ৬১৮-১৯২৫)

১. হযরত মূসা (আ.) ও হযরত ইউশা (আ.) এর যুগ

হযরত মূসা (আ.) ১২০ বছর জীবিত ছিলেন । তিনি তাঁর জীবনের প্রায় প্রথম ৩০ বছর মিশরের ফিরাউনের প্রাসাদে এবং হযরত শুআইব (আ.)-এর কাছে ক্বাদাশ বারনী নামক স্থানে ১০ বছর অতিবাহিত করেছিলেন । উল্লেখ্য যে, এ স্থানটি ফিলিস্তিনের দিক থেকে সীনাই পর্বতের শেষ প্রান্তে আরাবাহ্ উপত্যকার অদূরে অবস্থিত ।

বর্তমান তাওরাতের সিফরে খুরুজ পুস্তিকার ১২তম অধ্যায়ের ৩৭ নং আয়াতে এবং সিফরে আদাদ-এর ৩৩তম অধ্যায়ের ৩৬ নং আয়াতে যে সব ইসরাইলীয় হযরত মূসা (আ.)-এর সাথে হিজরত করেছিল তাদের সন্তানদেরকে বাদ দিয়ে তাদের সংখ্যা ছয় লক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । তবে কতিপয় পাশ্চাত্য গবেষকের মতে, তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় হাজার ।

ঐতিহাসিকগণ অধিকতর সম্ভাবনার ভিত্তিতে বলেছেন : খ্রিস্টপূর্ব ১৩ শতাব্দী আগে অর্থাৎ প্রায় খ্রি.পূ. ১২৩০ সালে ফিরআউন মিনফাতাহ্-এর আমলে ইসরাইলীরা মিশর ত্যাগ করেছিল ।

হযরত মূসা (আ.) কাদাশ পর্বতের কাছে মারা যান এবং তাঁর উত্তরাধিকারী ইউশা বিন নূন তাঁকে ঐ স্থানে দাফন করেন এবং তিনি তা গোপন রাখেন । হযরত মূসা (আ.) তাঁর জীবদ্দশায়, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও বনি ইসরাইলের কাছ থেকে বহু কষ্ট ও যাতনা পেয়েছিলেন । ইহুদীদের তাওরাতে তাঁর ও হযরত হারূন (আ.)-এর ব্যাপারে উল্লিখিত আছে যে, আল্লাহ্ মূসা (আ.)-কে বলেছিলেন :

“যেমন করে তোমার ভাই হারূন হুর পর্বতে মৃত্যুবরণ করেছে ঠিক তেমনি তুমিও এ পর্বতে মৃত্যুবরণ করবে । কারণ তোমরা দু’জন সীনাই দেশে কাদাশ ভূ-খণ্ডের জলাভূমিতে আমার পবিত্রতা ঘোষণা করনি আর এভাবে তোমরা দু’জন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ!! অতএব,তুমি যমীনকে ঠিক এর বিপরীত (দিক) থেকে দেখবে, অথচ যে ভূ-খণ্ড আমি বনি ইসরাইলকে প্রদান করেছি সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না ।”
আরো বলা হয়েছে : ইউশা বিন নূন সেখানে প্রবেশ করবেন।

মূসা (আ.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি নবী ইউশা বনি ইসরাইলের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । তিনি তাদেরকে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে নিয়ে যান এবং আবীহা (জেরিকো) শহর থেকে শুরু করে আরো ৩১টি ক্ষুদ্র রাজ্য জয় করেন যার প্রতিটি ছিল শহর বা ছোট শহর এবং এগুলোর প্রতিটির অধীনে বেশ কিছু কৃষিনির্ভর গ্রাম ছিল । উল্লেখ্য যে,এ সব নগররাজ্যের অধিবাসীরা ছিল কিনআন গোত্রীয় পৌত্তলিক ।

তখন তিনি ঐ অঞ্চলকে ইয়াকূব (আ.)-এর বংশধরদের মধ্যে বণ্টন করে দেন যারা একে অপরের প্রতি হিংসা-দ্বেষ পোষণ করত । ইউশার পুস্তিকায় ১৫ থেকে ১৯ অধ্যায়ে উক্ত অঞ্চলের নগর ও ক্ষুদ্র শহরের সংখ্যা ২১৬ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । হযরত ইউশা (আ.) খ্রিস্টপূর্ব ১১৩০ সালে প্রায় ১১০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন ।

২. হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামল

রাজা তালুতের যুগকে আমরা হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামলের অংশবিশেষ বলে গণ্য করব । কারণ যদিও তালূত নবী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন মহান নবীদের ধারার একজন শাসক । ঐতিহাসিকরা তাঁর শাসনামল খ্রি.পূ. ১০২৫ থেকে ১০১৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর বলে উল্লেখ করেছেন । তারপর হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.) খ্রি.পূ. ১০১০ সাল থেকে খ্রি.পূ. ৯৩১ সাল পর্যন্ত শাসন করেছেন । হযরত সুলাইমান (আ.) খ্রি.পূ. ৯৩১ সালে ইন্তেকাল করেন ।

বর্তমান তাওরাত (পুরাতন নিয়ম)-এর রচয়িতারা হযরত মূসা (আ.), হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর ওপর জুলুম করেছে এবং জঘন্য চারিত্রিক, রাজনৈতিক ও বিশ্বাসগত মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে।

পাশ্চাত্যের অধিকাংশ খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা কেবল এসব রচয়িতার অনুসরণ করেই ক্ষান্ত হয় নি, বরং তাঁদের বক্তব্যের সাথে আরো বেশ কিছু ভিত্তিহীন বিষয়ও যোগ করেছেন । অতঃপর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমর্থক মুসলমান নামধারীরাও পাশ্চাত্যের এসব লেখকের অনুসরণ করেছে । মহান আল্লাহর দরূদ ও সালাম তাঁর সকল নবী-রাসূলদের ওপর বর্ষিত হোক । আর যে সব ব্যক্তি এ সব মহামানবের ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে মহান আল্লাহর দরবারে আমরা তাদের থেকে সম্পর্কোচ্ছেদ ঘোষণা করছি ।

হযরত দাউদ (আ.) ইসরাইলীদেরকে পৌত্তলিকতা ও মুশরিকদের আধিপত্য থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং তাঁর ঐশ্বরিক শাসন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহেও বিস্তার লাভ করেছিল । যে সব জাতি তাঁর শাসনাধীন ছিল তিনি তাদের সাথে এমন সদাচরণ করতেন যে, মহান আল্লাহর পবিত্র কোরআনে এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কণ্ঠে তা বর্ণনা করেছেন ।

হযরত দাউদ (আ.) আল কুদসে মারীয়া পাহাড়ের ওপর তাঁর শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ইবাদত-বন্দেগী করার স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু সেখানে আরুনা নামের আল কুদসের ইয়াবূস বংশীয় একজন বাসিন্দার শস্যক্ষেত্র ছিল । হযরত দাউদ (আ.) ঐ লোকের কাছ থেকে ঐ জমি ৫০ শাকোল (ওজনের পিণ্ড) রূপার বিনিময়ে ক্রয় করেন । বর্তমান তাওরাতের বক্তব্য অনুসারে সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ এবং নামায কায়েম করেছিলেন । আর তিনি এর একটি অংশে মহান আল্লাহর জন্য কোরবানীও করতেন।

হযরত সুলাইমান (আ.) হযরত দাউদ (আ.)-এর রাজত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন । তাঁর হুকুমত ও রাজত্ব ঐ পর্যায়ে বিস্তার লাভ করেছিল যার উল্লেখ পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ্য় বিদ্যমান । তিনি তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা হযরত দাউদ (আ.) এবং শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মসজিদটিকে একটি জাঁকজমকপূর্ণ ইমারতে রূপান্তরিত করেছিলেন যা  ‘মা’বাদ-ই সুলাইমান’ অর্থাৎ The temple of King Solomon নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে।

হযরত সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামল মহান নবীদের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমধর্মী যুগ । এ যুগে মহান আল্লাহ্ তাঁর আশ্চর্যজনক ও বিচিত্র নেয়ামতসমূহের কিছু নমুনা মানব জাতির কাছে প্রকাশ করেছিলেন । যদি জাতিসমূহ মহান নবী এবং তাঁদের উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বের রাজনৈতিক ধারাটি বহাল রাখত এবং মহান আল্লাহর প্রদত্ত নেয়ামতসমূহ একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দমন কার্যে ব্যবহার না করত, তাহলে মহান আল্লাহ্ তাদেরকে এ সব নেয়ামত নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রদান করতে থাকতেন । মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন :

“মহান আল্লাহ্ যদি মানব জাতির জন্য অজস্র জীবিকার ব্যবস্থা করতেন, তাহলে তারা পৃথিবীতে অন্যায়-অত্যাচার করত । কিন্তু মহান আল্লাহ্ যতটুকু চান কেবল ততটুকুই তিনি অবতীর্ণ করেন । আর তিনি তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে জ্ঞাত এবং তাদের সব কিছু দেখেন।”

হযরত সুলাইমান (আ.) নিজ সিংহাসনের ওপর উপবিষ্টাবস্থায় প্রাণ ত্যাগ করেন । ঐতিহাসিকরা তাঁর মৃত্যুর তারিখ খ্রিস্টপূর্ব ৯৩১ সাল বলে উল্লেখ করেছেন ।

হযরত সুলাইমানের মৃত্যুর সাথে সাথেই বনি ইসরাইলের মধ্যে বিচ্যুতি এবং তাদের হুকুমত ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিভক্তি দেখা দেয় । আর এ কারণেই মহান আল্লাহ্ তাদের ওপর এমন ব্যক্তিকে কর্তৃত্বশীল করে দিয়েছিলেন যে তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করিয়েছিল।

বর্তমান তাওরাতের রাজন্যবর্গ ও শাসকদের প্রথম পুস্তিকায় সুলাইমান (আ.)-এর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা হয়েছে এভাবে যে, তিনি মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী বর্জন করে মূর্তি পূজা করতেন । তাওরাতে উল্লিখিত হয়েছে : “তিনি সুলাইমানকে বললেন : এ শাস্তির কারণ তুমি নিজেই । যে সব চুক্তি এবং ওয়াজিব বিধান পালন করার আদেশ আমি তোমাকে দিয়েছিলাম, তুমি সেগুলো সংরক্ষণ কর নি । আমিও তোমার হাত থেকে রাজত্ব কেড়ে নিয়ে তা টুকরো টুকরো করে ফেলব ।”

৩.বিচারকদের যুগ

অস্থিতিশীল যুগের বিচারকদের শাসন কর্তৃত্ব এবং ইহুদী জাতির ওপর স্থানীয় শাসক ও রাজন্যবর্গের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তার : হযরত ইউশা ইবনে নূনের পর বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব বিচারকদের কাছে স্থানান্তরিত হয় এবং তাদের মধ্যে ১৫ জন শাসনকর্তা হয়েছিল । তাদের যুগের দু’টি বৈশিষ্ট্য সবসময় বনি ইসরাইলের মাঝে লক্ষ্য করা যায়।

একটি বৈশিষ্ট্য হলো মহান নবীদের পথ থেকে তাদের (বিচারকদের) বিচ্যুতি এবং অপর বৈশিষ্ট্য হলো মহান আল্লাহ্ কর্তৃক এমন সব ব্যক্তিকে তাদের ওপর কর্তৃত্বশীল করা যারা তাদের অত্যন্ত বেদনাদায়ক শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবে;আর এ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে ।

তৃতীয় ও পঞ্চম অধ্যায়ে বিচারকদের পুস্তিকায় হযরত ইউশা (আ.)-এর পর বনি ইসরাইলের বিচ্যুতির কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছে :

কিনাআনী, হেইথী, আমূরী, ফার্যী, হেভী ও ইয়াবুসীয়দের মাঝে তারা বসবাস করতে থাকে এবং ঐসব জাতির মেয়েদেরকে তারা স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিল এবং নিজেদের কন্যাসন্তানদেরকে তারা তাদের ছেলেদের কাছে বিবাহ দিয়েছেল । তারা ঐ সব জাতির প্রতিমা এবং দেব-দেবীদেরও পূজা করত ।

তৃতীয় অধ্যায়ের ৮ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে : বিচারকদের মধ্য থেকে যে সর্বপ্রথম বনি ইসরাইলের ওপর শাসনকর্তৃত্ব লাভ করেছিল এবং তাদেরকে ৮ বছর শাসন করেছিল সে ছিল আরামুন নাহরাইনের শাসনকর্তা রাশ্তাআম।

তখন বনি আম্মোন এবং আমালিকারা তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আরীহা (জেরিকো) শহর দখল করে নেয় ।৩ এরপর কিনআন দেশের শাসনকর্তা ইযারীন হাসূর অঞ্চলে তাদের ওপর ১০ বছর শাসন করেছিল।

এরপর বনি আমোন ও ফিলিস্তিনীরা তাদেরকে ১৮ বছর দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছিল।
এরপর ফিলিস্তিনীরা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল এবং চল্লিশ বছর তাদেরকে নিজেদের আধিপত্যাধীন রেখেছিল।

ইউশা ইবনে নূনের পর বিচারকদের শাসন নবী হযরত সামূঈল (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল । হযরত সামূঈল (আ.) ছিলেন ঐ নবী পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ নিম্নোক্ত আয়াতে যাকে এভাবে স্মরণ করেছেন :

“আপনি কি বনি ইসরাইলের ঐ গোত্রকে দেখেছেন যারা মূসার পরে তাদের নবীর (সামূঈল) কাছে এ প্রার্থনা করেছিল : আপনি আমাদের জন্য এমন একজন বাদশাহ্ নিযুক্ত করে দিন যাতে করে আমরা মহান আল্লাহর পথে জিহাদ করতে পারি । তাদের নবী বলেছিলেন : তোমাদের ওপর জিহাদ অবধারিত (ফরয) হয়ে গেলে কি তোমরা নাফরমানী করবে? তারা বলেছিল : এটি কিভাবে সম্ভব যে, আমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করব না । অথচ তারা আমাদেরকে এবং আমাদের সন্তানদেরকে আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে । অতঃপর যখন তাদের ওপর জিহাদ নির্ধারণ করা হলো তখন তাদের মধ্য থেকে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ব্যতীত সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং মহান আল্লাহ্ অত্যাচারীদের ব্যাপারে পূর্ণ অবগত আছেন।”

ঐতিহাসিকরা এ যুগকে খ্রিস্টপূর্ব ১১৩০ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০২৫ সাল পর্যন্ত একশ’ বছর অর্থাৎ হযরত তালুত ও হযরত দাউদ (আ.)-এর শাসনকালের শুরু পর্যন্ত বলে মনে করেন, অথচ তাওরাতে বিচারকদের পুস্তিকায় এ সময় কাল (বিচারকদের শাসনকাল) একশ’ বছরের চেয়েও অধিক  বলে উল্লিখিত হয়েছে ।

চলবে......

পঠিত : ১৪৭৭ বার

মন্তব্য: ০