Alapon

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অভিশপ্ত ইহুদী জাতি (পর্ব-২)

(পূর্ব প্রকাশের পর)

৪. অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যুগ

তাদের অধঃপতন এতটাই হয়েছিল যে, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য তাদের মধ্যকার পৌত্তলিকরা মিশরের ফিরাউন, আশুরীয় ও ব্যাবেলনীয়দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল।

হযরত সুলাইমান (আ.)-এর মৃত্যুর পর ইহুদীরা শেকীম (নাবলুস) নামক স্থানে সমবেত হয়ে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইয়ারবাআম বিন নাবাত-এর হাতে বাইআত করে। উল্লেখ্য যে, এ ইয়ারবাআম বিন নাবাত হযরত সুলাইমানের অন্যতম শত্রু ছিল। সে সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামলে মিশরে পালিয়ে যায় এবং ফিরআউনদের কাছে আশ্রয় নেয়।

হযরত সুলাইমান (আ.)-এর মৃত্যুর পর সে ফিরে আসলে ইহুদীরা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল । সে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ‘ইসরাইল’ নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল যার রাজধানী ছিল শেকীম বা সামেরাহ্ । খুব অল্প সংখ্যক ইহুদী হযরত সুলাইমানের পুত্র রাহাবাআমের হাতে বাইআত করে । রাহাবাআমের রাজ্য ‘ইয়াহুদা’ নামে পরিচিত ছিল । এ রাজ্যের রাজধানী ছিল আল কুদ্স (জেরুজালেম)।

কিন্তু আসিফ বিন বারখিয়া যিনি ছিলেন হযরত সুলাইমান (আ.)-এর উত্তরাধিকারী, মহান আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেছেন : (عنده علم من الكتاب) অর্থাৎ তার কাছে কিতাবের কিছু জ্ঞান ছিল । বনি ইসরাইল তাঁর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছিল । তিনি বনি ইসরাইলের কাছ থেকে মিথ্যা অপবাদ লাভ করা ছাড়া আর কিছুই পান নি ।

তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে : “কুফর ও মূর্তিপূজা ইয়ারাবাআম-এর অনুসারীদের মধ্যে প্রকাশ্যে বিদ্যমান ছিল । সে স্বর্ণ দিয়ে দু’টি গোবৎস মূর্তি বানিয়ে এগুলোর একটি আল কুদসে এবং অপরটি দানে স্থাপন করেছিল । সে প্রতিটি মূর্তির পাশে একটি করে কোরবানী করার জায়গাও নির্মাণ করেছিল এবং তাদেরকে বলেছিল : “তোমাদের খোদারাই তোমাদেরকে মিশর থেকে বের করে শেকীমে এনেছেন । অতএব, তাঁদের সামনে তোমরা কোরবানী করবে এবং ঊরশালিমে যাবে না ।” আর ইহুদী জাতিও তার কথা মেনে নিয়েছিল ।

গোবৎস উপাসনা করার পাশাপাশি ইয়ারাবাআম তাদেরকে অন্যান্য দেব-দেবী, যেমন- সাইদূনীদের দেবতা আশতারুত (عشتروت), মুআবীদের দেবতা কামুশ (كموش) এবং আমোনদের দেবতা মাকলুম (مكلوم)-এর উপাসনা করার আদেশ দিয়েছিল।

আদি রাজা ও শাসকবর্গের কাহিনীসমূহ সংক্রান্ত পুস্তিকার বক্তব্য অনুসারে ইয়াহুদা রাজ্যও তিন বছর পরে এই একই পরিণতি বরণ করেছিল (অর্থাৎ সেখানেও মূর্তিপূজা, পৌত্তলিকতা এবং শিরকের প্রসার হয়েছিল)।

মিশরের ফিরআউন শীশক (شيشق) এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইয়ারাবাআমকে সাহায্য ও ইয়াহুদা রাজ্যের ধ্বংস সাধন করার জন্য খ্রি.পূ. ৯২৬ সালে হযরত সুলাইমান (আ.)-এর পুত্র রাহাবাআম ও তাঁর অনুসারীদেরকে পরাজিত করে আল কুদ্স দখল করে এবং বেথ-ঈল (মহান আল্লাহর গৃহ)-এর ধনভাণ্ডার, শাসনকর্তার সিংহাসন, এমনকি হযরত সুলাইমান (আ.) যে সব স্বর্ণের ঢাল বানিয়েছিলেন সেগুলো নিজের সাথে নিয়ে গিয়েছিল।

সম্ভবত মিশরের ফিরআউনের নিজ রাজ্যে দুর্বল অবস্থানের কারণে নিজে অথবা তার সহযোগীর (ইয়ারাবাআম) মাধ্যমে ইয়াহুদা রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে পারে নি।

অতএব, শীশকের পশ্চাদপসরণ করার পর এ ক্ষুদ্র রাজ্যটি নিজ অবস্থান কিছুটা ফিরে পেয়েছিল এবং তারা ইয়ারাবাআমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছিল। আরামীরা উক্ত রাজ্যদ্বয়ের দুর্বলতার সুযোগ নেয় এবং ইয়াহুদা রাজ্য আক্রমণ করে সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে বন্দী করে নিজেদের রাজধানী দামেশকে নিয়ে যায়। তারা বিজিতদের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করে । এ ঘটনা আরামী বিন হুদের রাজত্বকালে (খ্রি.পূ. ৮৭৯- খ্রি.পূ. ৮৪৩) ঘটেছিল ।

অতঃপর আখাব বিন আওমেরীর রাজত্বকালে খ্রি.পূ. ৮৭৪- খ্রি.পূ. ৮৫৩ সালের মধ্যে আরামীয়রা ইয়ারাবাআমের রাজ্যের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করে সে দেশকেও তাদের করদ রাজ্যে পরিণত করেছিল ।

একইভাবে তাওরাতে ইয়েহুরামের শাসনকালে ইয়াহুদা রাজ্যের সাথে কোশেসীয়ীদের যুদ্ধে আরবদের সাথে ফিলিস্তিনীদের যুদ্ধ ও সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তারা আল কুদ্স দখল করে শাসনকর্তার প্রাসাদে সংরক্ষিত ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল এবং তার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে বন্দী করেছিল ।

তাওরাতে আরো বর্ণিত আছে : “আরামীয় সেনাবাহিনী বাইতুল মুকাদ্দাসে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং সেখানকার সকল নেতাকে হত্যা করতঃ সকল ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে । অতঃপর তারা সে সব লুণ্ঠিত ধন-সম্পদ আরামীয়দের রাজা হাযাঈলের কাছে অর্পণ করে ।”

ঠিক একইভাবে ইসরাইল রাজ্যের শাসনকর্তা ইউআশ ইয়াহুদা রাজ্য আক্রমণ করে নগরীর দুর্গ ধ্বংস করেছিল । সে মহান আল্লাহর ঘরে সংরক্ষিত যাবতীয় স্বর্ণ, রৌপ্য, বাসন-কোসন এবং রাজকীয় কোষাগার লুণ্ঠন করেছিল ।

আশুরীয়দের দখল করার আগ পর্যন্ত বনি ইসরাইলের মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় অবস্থা এবং তাদের ওপর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকে।

৫. আশুরীয়দের আধিপত্য বিস্তারের যুগ

খ্রি. পূ. ৮৫৯ সাল থেকে খ্রি. পূ. ৮২৪ সাল পর্যন্ত আরামীয় রাজ্য ও ইসরাইলে আশুরীয় রাজ তৃতীয় শালমান্নাসরের আক্রমণের মাধ্যমে ইহুদীদের ওপর আশুরীয়দের আধিপত্যের সূত্রপাত ঘটে । পুরো অঞ্চলই তার এবং তার পরবর্তী আশুরীয় রাজন্যদের শাসনাধীনে চলে যায় । তবে সম্ভবত প্রথমে ইসরাইল রাজ্যের পরিবর্তে ইয়াহুদা রাজ্যটি আশুরীয়দের শাসনাধীনে এসেছিল ।

কারণ তাওরাতের বর্ণনানুসারে সেখানকার শাসনকর্তা আহায বিন ইউসাম আশুর রাজ্যের নৃপতি তাঘলিস ফালাসারকে ইসরাইল ও আরামীয়দের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর জন্য আহবান করেছিল; আর আশুর রাজও তার সর্বশেষ আবেদন গ্রহণ করে খ্রি.পূ. ৭৩২ সালে আক্রমণ করার উদ্যোগ নেন ।

আশুর রাজের উত্তরাধিকারী নৃপতি ৫ম শালমান্নাসরও তাঁর পূর্বসূরির কর্মপন্থা অব্যাহত রাখেন । কিন্তু তিনি ইসরাইলের রাজধানী শেকীম (নাবলুস) অবরোধকালে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত নৃপতি দ্বিতীয় সিরজাওন সামেরাহ্ নগরী পুরোপুরি দখল করেছিলেন এবং এভাবে তিনি এ দেশটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন ।

ইসরাইল আক্রমণ করার মাধ্যমে ইহুদীদেরকে তাদের দেশ ও মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা হয় । তাঘলিস ফালাসার ইহুদীদেরকে বন্দী করে নিজ দেশে নিয়ে আসেন এবং আশুরীয়দেরকে তাদের দেশে আবাসন দেন ।

তারপর সুলতান ফাকাহ্ উক্ত পরিকল্পনা সমাপ্ত করেন এবং তিনি মানসীর বংশধরদের ও ইহুদী জনসংখ্যার অর্ধেকাংশকে বন্দী করেছিলেন ।
দ্বিতীয় সিরজাওন প্রায় ত্রিশ হাজার ইহুদীকে হাররান, খাবূর নদীর তীর এবং মিডিয়ায় নির্বাসিত করেন এবং তাদের স্থলে আরামীয়দেরকে আবাসন দেন ।

হিযকিয়ার শাসনামলে ইয়াহুদা রাজ্য আশুরীয়দের হাত থেকে বের হয়ে আসে । বাহ্যত তিনি মিশরীয়দের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করছিলেন । তাঁর এ উদ্যোগে আশুর রাজ্যের নৃপতি সিনহারীব তার ওপর খুব ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং খ্রি. পূ. ৭০১ সালে ইয়াহুদা রাজ্যকে বশীভূত করার জন্য এবং আশুরীয়দের সর্বশেষ আক্রমণের মাধ্যমে উক্ত অঞ্চল নিজ শাসনাধীনে আনেন এবং আল কুদ্স দখল করেন । হিযকিয়া মহান আল্লাহর গৃহে বিদ্যমান যাবতীয় রৌপ্য এবং শাসনকর্তার প্রাসাদে গচ্ছিত সকল ধন-সম্পদ তাঁর কাছে অর্পণ করেছিলেন ।

বর্তমান তাওরাতে আশুর দেশের যে সব নৃপতির বিবরণ প্রদান করা হয়েছে তাঁরা ব্যতীত আসরহাদ্দুন এবং তাদের সর্বশেষ নৃপতি আশুর বানিবাল সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেছে : “এ দু’জন আশুর রাজ্য থেকে বেশ কিছু সম্প্রদায়কে সামেরাহ্ নগরীতে এনে আবাসন দিয়েছিলেন ।”
৬. বাবেলীয়দের আধিপত্য বিস্তারের যুগ

মাদ ও বাবেলীয়দের (কালদানীদের) হাতে খ্রি.পূ. ৬১২ সালে আশুরীয়দের রাজধানী নেইনাভার পতন ঘটে এবং উক্ত রাজ্যকে বিজয়ীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় । ইরাক, শাম ও ফিলিস্তিন বাবেলীয়দের ভাগে পড়ে । তাদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন বাখতুন নাসর- যিনি শাম ও ফিলিস্তিনকে নিজ শাসনাধীনে আনার জন্য খ্রি.পূ. ৫৯৭ সালে প্রথম বার এবং খ্রি.পূ. ৫৮৬ সালে দ্বিতীয় বার সেখানে আক্রমণ করেছিলেন।

প্রথম আক্রমণে তিনি আল কুদ্স অবরোধ ও জয় করেন । তিনি সেখানকার শাসনর্তার প্রাসাদের যাবতীয় ধন-রত্ন ও সম্পদ হস্তগত করেন । বিরাট সংখ্যক ইহুদী, এমনকি সুলতান ইয়াহুভা ইয়াকীন ও তাঁর সমর্থকদেরকে বন্দী করেন এবং ধৃত সুলতানের পিতৃব্য সিদিকইয়াকে অবশিষ্ট ইহুদীদের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন । তিনি বন্দীদেরকে বাবিলের (ব্যাবিলনের) খাবূর নদীর কাছে নাইবূর এলাকায় নির্বাসিত করেন ।২৪

দ্বিতীয় আক্রমণ : বাখতুন নাসর ও মিশরের ফিরআউন খোফরার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে । কারণ, ফিরআউন খোফরা শাম ও ফিলিস্তিনের শাসনকর্তাদের, যেমন আল কুদসের নয়া শাসক সিদিকইয়াকে বাবেলীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য প্ররোচিত করতে থাকে এবং তাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে । তারাও তা মেনে নেয় এবং মিশরের ফিরআউন অত্র অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে ।

কিন্তু বাখতুন নাসর দ্রুত আরেকটি আক্রমণ পরিচালনা করে মিশরীয়দেরকে পরাজিত করেন এবং সমগ্র অঞ্চল তাঁর করায়ত্তে চলে আসে । ইহুদীদের উপাসনালয়ে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস এবং তাদের ধন-ভাণ্ডারসমূহ লুণ্ঠন করা হয় । তাদের সব ঘর-বাড়ি ধ্বংস এবং প্রায় পঞ্চাশ হাজার ইহুদীকে বন্দী করা হয় ।

সিদিকইয়ার সন্তানদেরকে বাখতুন নাসরের সামনে জবাই এবং তারপর সিদিকইয়ার দু’চোখ উপড়ে ফেলা হয় । তাকেও পায়ে বেড়ী পড়িয়ে বন্দীদের সাথে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এভাবেই ইয়াহুদা রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায় ।

চলবে......

পঠিত : ১৪৭০ বার

মন্তব্য: ০