Alapon

সালাফি অভিজ্ঞাত...

বাসার পাশের মুদির দোকানিটা ঘনকালো লম্বা দাঁড়ির একজন যুবক। চেহারায় এক অন্য রকম দ্যুতি খেলা করে প্রতিনিয়ত। কপালে একটা কালো দাগ। সদা সহাস্য। দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। মিসরে দাঁড়ি রাখাটা অনেক কঠিন। আগুনের উপর পা দিয়ে চলার মতো। যারা রাখে তারা সরকারীভাবে কী পরিমান ভোগান্তির শিকার হয় তা একমাত্র তারাই জানে। শীতের কাপড় কিনতে তিন মাস আগে মার্কেটে গিয়েছিলাম। দোকানী কথার এক ফাঁকে আমাকে বললো- তুমি মিসরী না, সেটা বুঝেছি। আমি বললাম- কিভাবে? বলল- তোমার দাঁড়ি দেখে। আমরা হলে এতো দিনে তুররা উপত্যাকায় থাকতাম। তোররা মিসরের প্রসিদ্ধ আন্ডারগ্রাউন্ড জেল। তো, মিসরী কোন যুবকের দাঁড়ি দেখলে বুঝতে হবে সে হয়তো সালাফী, অথবা ইখওয়ান! আমার মুদীর দোকানীটা ছিল সালাফী। সে-দিন তার দোকানে গেলাম। দেখলাম টিভির সংবাদ দেখছে। চেহারায় রাজ্যের হতাশা। জিজ্ঞেস করলাম-- কী হয়েছে? বলল-- কী আর হবে? সবই আমাদের নসীব! (বাদশাহ) সালমান আর তার ছেলে তো দুনিয়াটাই ধংস করে দিল। কী সৌদি আরব কী হয়ে গেল! তখন টিভিতে সৌদি আরবে মিসরী গায়ক তামের হোসনীর কনসার্টের গরম খবর প্রচারিত হচ্ছিল।

দীর্ঘ দিন ধরে আরব দেশে থাকার সুবাদে সালাফীদেরকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাদের সাথে প্রচুর আলাপ আলোচনা করার সুযোগ হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে-- মিসরের সালাফীরা একটি অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে ব্ল্যাকমেইলের শিকার। এই গোষ্ঠীটি মিসরের সাধারণ সালাফী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না। আমাদের দেশে মিসরী সালাফীদের যে খবরগুলো প্রচার হয় সেগুলো এদের। এরা চোখ বুজে জালিমের সাথে হাত মেলায়, আর মাজলুমের কাফির হওয়ার ফতোয়া দেয়। শাসকের জুলুমের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাকে হারাম বলে, আবার হাকিমে মুতাগাল্লিবের আনুগত্য করা ফরজ বলে। বৈধ শাসকের বিরুদ্ধে ক্যুতে সরাসরি অংশগ্রহন করে এবং জালিমদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে। এই গোষ্ঠীর এক শায়খের নাম সাঈদ রাসলান। তিনি একটি খোৎবায় বলেছেন-- ইখওয়ানীরা বদতরীন ইনসান। এদের সাথে কোন লেনদেন করবে না। তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না। তাদের দোকান থেকে কিছু কিনবে না। এমন কি তাদেরকে সালাম দিবে না, তারা দিলে উত্তরও দিবে না। তিনি কোন ছোটখাট শায়খ নন। বেশ প্রসিদ্ধ শায়খ। শতশত ছাত্রকে দারস দেন প্রতিদিন। কিছু দিন আগে মাদখালী সালাফীরা লিবিয়ার একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, শায়খ নাদেরকে হত্যা করেছিল। হত্যাকারী ভিডিও টেপে স্বীকার করেছে যে, শায়খ রাসলানের ফতোয়া পেয়েই সে শায়খ নাদেরকে হত্যা করে। এই গোষ্ঠীর বর্তমান রাজনৈতিক দল হচ্ছে 'হিযব আন নুর'। এদের কর্মকান্ডে সিংহভাগ সালাফী ত্যক্তবিরক্ত। জালিমের হেন কোন জুলুম নেই, যা তারা সমর্থন করছে না। গীর্জায় গিয়ে পাদ্রীর সাথে বুক মেলায় আর কারাবন্দী মাজলুম প্রেসিডেন্টকে প্রতিনিয়ত গালি দেয়। এদের কর্মকান্ড দেখলে যে কেউ এদের মুসলমানিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করার আগে মনুষ্যত্ব নিয়ে চিন্তা করবে। মিসরে বর্তমানে দ্রব্যমূল্য সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। মুদ্রার মান অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় এই দলের ফতোয়া-- 'দ্রব্যমূল্য নির্ধারন হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। সরকারের কোন দায় নেই। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, দোয়া করা ছাড়া।' এদের অবস্থা দেখলে বুঝে আসে, কেন ফরাসী বিপ্লবের শ্লোগান ছিল-- 'পাদ্রীদের পেটের আঁতুড়ি দিয়ে রাজাকে ফাঁসিতে ঝুলা।' কয়েকদিন আগে এই দলের প্রধান শায়খ বারহামী নতুন ঘোষণা দিয়েছেন-- 'তুর্কি সিরিয়াল এরতুগ্রুল দেখা যাবে না। কারণ, সেখানে উসমানী বীরদেরকে বড় করে দেখানো হচ্ছে এবং ইবনুল আরাবী চরিত্রের মাধ্যমে ভ্রান্ত সুফীবাদের দিকে আহবান করা হচ্ছে।' মূল ব্যাপারটি হচ্ছে, তুরস্ককে নিয়েই তার গাত্রদাহ। মিসর সৌদীর বর্তমান তুর্কি বিরোধী অস্থানের দিকে তাকিয়ে তাদেরকে খুশি করার একটা প্রচেষ্টা। বর্তমান আরব শাসকদের ইহুদী প্রীতি নিয়ে তার কোন বক্তব্য নাই। সৌদীর সিনেমার কথা বাদই দিলাম। এদের অবস্থা দেখে এক আরব লেখক লিখেছে-- তাদের কাছে "কবরের ইবাদত" শিরিক। কিন্তু "কসরের ইবাদত" (রাজপ্রাসাদের ইবাদত) ঈমানের অঙ্গ।

কোথায় যেন পড়েছিলাম, হযরত হোসাইন রাজি. এর হত্যাকারীদের একজন নাকি একবার এক ফকীহের কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল-- হযরত! অনিচ্ছাকৃতভাবে হারাম শরীফে ফড়িংয়ের একটা পাখা ছিঁড়ে ফেলেছি। এখন এর হুকুম কী?


পঠিত : ১৮৩৯ বার

মন্তব্য: ০