Alapon

শাপলা চত্বর ট্রাজেডি : চোখের দেখা বাস্তবতা বনাম মিডিয়া সন্ত্রাস

সারাদেশ থেকে আলেম ওলামা আর ইসলামপ্রিয় সাধারণ মানুষরা  আসছেন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ডেমরা অংশের পাশেই ছিল আমার বাসা। তাই তাদের খাবার দেয়ার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ভাগেও। দিনভর সুলতানা কামাল সেতুর ঢালে খাবার সরবরাহ করেছি। এখানে কাজ করলেও মন পড়েছিল শাপলা চত্বরে। দুপুর একটার দিকে সিদ্ধান্ত হলো আমরাও যাবো। দুদিনের নির্ঘুম রাতের কারণে ততক্ষণে শরীর খুব ক্লান্ত, তবু মন থেকে বেশ শক্তি পাচ্ছিলাম। 

বিশাল মিছিলের সঙ্গে রওনা হলাম মতিঝিলের উদ্দেশ্যে। লাখো মানুষের ভীড়ে হেটেই এগিয়ে গেলাম মতিঝিলের দিকে। পথে যখনি পিপাসা লেগেছে চাওয়ার আগে পাশ থেকে শরবত ও শুকনো খাবার দিয়েছেন অসংখ্য শুভাকাঙ্খি। 

আমরা যখন টিকাটুলির কাছাকাছি ঠিক তখন বিশাল বোমার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু একটুও ভয় হয়নি। মিছিলের শ্রোত তখনো মতিঝিলমুখী। ততক্ষণে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। আমরা গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন রোডের মাথায় বসলাম। কিছুক্ষণ শ্লোগান দেয়ার পর শিবিরের মহানগরী দক্ষিণের সভাপতি এসে বললেন, দৈনিক বাংলার দিকে নিরীহ আলেমদের ওপর হামলা করছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। আমাদেরকে তাদের সহায়তায় এগিয়ে যেতে হবে।

সাথে সাথে সবাই মিছিল নিয়ে রওনা হলাম। আমাদের মিছিল যখন দৈনিক বাংলা মোড়ের কাছাকাছি ঠিক তখন একটা মোটরসাইকেল এগিয়ে এলো। মিছিলের সামনে দাঁড়িয়েই মাহনগরী সভাপতিসহ সামনের সারির ভাইদের লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি শুরু। সাথে সাথে জীবনের ঝঁকি নিয়ে হামলাকারীদের দিকে দৌঁড় দিলেন আমাদের কয়েকজন। বুঁঝে উঠার আগেই ধরে ফেললেন হামলাকারীদের। ধরে সেই মোটরসাইকেলের তেল দিয়েই আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় মোটরসাইকেলটিতে। আর মোটরসাইকেলে থাকা দুই সন্ত্রাসীকে গণপিটুনি দেয়া হচ্ছিল। পরে মাহনগরী সভাপতি বিক্ষুদ্ধ জনগণের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করে মানবতার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি তাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেন। সবাই যখন ক্ষিপ্ত তখন সবাইকে সান্তনা দিয়ে বলেন, ‘শত্রু হলেও তার জীবনের নিরাপত্তা দেয়া আমাদের দায়িত্বের অন্তভুক্ত’।

যাইহোক, এখান থেকে দৈনিকবাংলা মোড়ে পৌঁছে দেখি একপ্রকার রণক্ষেত্র। নিরীহ আলেমদের উপর সর্বশক্তি দিয়ে হামলা করছে পুলিশ ও আওয়ামী ক্যাডাররা। গুলি আর গ্রেনেডের প্রতিরোধে রাস্তা থেকে ইট তুলে মারছেন সাধারণ জনতা। হঠাৎ দেখি রিকশা ভ্যানে করে একটি লাশ আনা হলো। মরদেহটি ছিল ক্ষতবিক্ষত। শুধু একটি নয়, ভ্যানে করে একের পর এক ক্ষতবিক্ষত দেহ আসতে থাকে। কিছু ডাক্তার ভাই দৌঁড়ে যাচ্ছেন তাদের জীবন রক্ষায়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।

বায়তুল মোকাররমের সামনে তখন তুমুল সংঘর্ষ। গুলি আর সাউন্ড গ্রেনেডের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধের চেষ্টা করছি ইট দিয়ে। আমি গঠনগতভাবে ছোট হওয়ায় ভালোভাবে ঢিল ছুড়তে পারতাম না। তাই আমি আর কয়েকজন বৃদ্ধ মিলে ইট ভাঙছিলাম। আর অন্যরা সেটা নিয়ে ছুড়ছিল। এভাবে রাত প্রায় ৮টা পর্যন্ত চেষ্টার পর হঠাৎ গুলিস্তানের দিক থেকে আওয়ামী লীগের একটি সশস্ত্র গ্রুপ এসে পাশ থেকে হামলা করলে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। পল্টন ছেড়ে দৈনিক বাংলায় অবস্থান নেই। এরই মধ্যে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় ধাউ ধাউ করে আগুন জ্বলতে দেখি। আমরা ভেবেছিলাম ওরা বোধয় মসজিদ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আবারো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও মসজিদ রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। গিয়ে দেখি বাইতুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের দোকানগুলোতে আগুন দিয়ে লুটপাট করছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ধাওয়া দিয়ে কয়েকজনকে ধরে ফেলা সম্ভব হয়। গণপিটুনি দিয়ে ছেড়ে দেয়াও হয়। অথচ পরে মিডিয়ায় দেখি কোরআন পোড়ানো হয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে আলেমদের বিরুদ্ধে। তারা প্রচার করেছিল আলেমরাই নাকি দোকানপাট ভাঙচুর করেছে ও কুরআন জ্বালিয়েছে। যা দেখে এদেশের মিডিয়াকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার।

ততক্ষণে আশপাশে আর পরিচিত কাউকে দেখছি না। রাত দশটার দিকে ডেমরা থানা সভাপতিকে কল দিলে তিনি বললেন, মতিঝিলে চলে আসো। অনেক কষ্টে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ফাঁকি দিয়ে মতিঝিল গেলাম। আমেরিকান লাইফ ইন্সুরেন্সের গলিতে আমাদের অবস্থান। শরীর খুব ক্লান্ত খুধাও অনেক। বড়ভাই ৩টা টোস্ট আর একটা কলা সংগ্রহ করে দিলেন। খেয়ে কোনোরকম পেট শান্ত করলাম। রাত ১২টার দিকে উনি বললেন তোমার অবস্থা খুব খারাপ মনে হচ্ছে একটু রেস্ট নাও। ভাইয়ের পায়ের উপর মাথা রেখেই রাস্তায় শুলাম। শুইতেই চোখ লেগে এলো। 

রাত সম্ভাবত তখন ২টা। হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। এরপর টানা গোলাগুলি আর সাউন্ড গ্রেনেড। জীবন বাঁচাতে ছুটছে নিরীহ আলোমরা। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ধুপ করে পড়ে যাচ্ছে কেউ। তুলতে যাবো, নিজের জীবনও শঙ্কায়। পড়ে থাকা কত লাশের উপর দিয়ে হেটেছি তার সঠিক সংখ্যা বলতে পারবো না। তবে এইটুকু মনে আছে লাশের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে তিনবার পড়ে গেছি। রক্তাক্ত কয়েকজনকে ধরে উঠানোর চেষ্টাও করেছি। কিন্তু রায়টকারের সঙ্গে পেরে উঠিনি। শক্তিশালি টিআর গ্যাসের কারণে কিছুই দেখছিলাম না। বেশকয়েকজন মিলে একটু প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। কারণ আমাদের হাতে কিছু নেই। ইটও নেই। সবশেষ বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ।

এবার ফিরে যাওয়া। পথে পথে বাধা। ডেমরা-যাত্রবাড়ী সড়কে হুজুর দেখলেই আওয়ামী সন্ত্রাসীদের মারধোর আর চরম অপমান চলছিল। কারো হাত ভেঙে দিচ্ছে, কারো পা আবার কারো জুব্বা ছিঁড়ে দিয়ে উপহাস করছিল ওরা। আমরা যারা শার্ট-প্যান্ট পরা ছিলাম তারা মোটামুটি নিরাপদই ছিলাম। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তখনো গোলাগুলি চলছে। এক ভাই ফোনে জানালেন ডেমরা রোডে হুজুরদের পেলেই খুব মারছে সুযোগ থাকলে ভেতর দিয়ে যেতে। পরে আমি কয়েকজন হুজুরকে এই সংবাদটি দিলে তারা ভেঙে পড়েন। আমার কাছে করজোড় অনুরোধ করেন তাদের নিরাপদে পৌঁছে দিতে। পরে প্রায় দশজন নিয়ে ভেতর দিয়ে হেটে রওনা হই। বাসার কাছে যেতে প্রায় নয়টা বেজে যায়। সারুলিয়া বাজার যেতেই কিছু টাকা দিয়ে হুজুররা বলেন, ভাই আমাদের শার্ট-প্যান্ট কিনে দেন। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের এক শুভাকাঙ্খি দোকানির কাছ থেকে মোটামুটি কম খরচে কিছু কাপড় কিনে দেই। কিছু টাকা শর্ট ছিল দেখে আমি পরে দেব বলে তাদের বিদায় দিয়ে চলে আসি। বিদায় মুহূর্তে তারা সেদিন সুধু এটুকু বলেছিলেন, এতদিন শিবিরকে অনেক খারাপ জেনেছি এখন মনে হচ্ছে আজকে দিনে শিবির আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যকারী হিসেবে এসেছে। তারা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন খুব। নিজ জেলায় গিয়েও অনেকদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন তারা।

তখনো চিটাগাং রোডের দিকে চরম গোলাগুলি চলছে। গুলি আর গ্রেনেডের শব্দ স্পষ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। মনে মনে বলছিলাম, নাজানি কোন মায়ের বুক খালি করছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীরা। 

তিনদিনের ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাসায় ঢুকতেই ঘুম চলে এলো। অনেকবার কল এসেছে কিন্তু টের পাইনি। ১২টার দিকে থানা সেক্রেটারির ভাইয়ের কল পেয়ে জেগে উঠি। রিসিভ করতেই ভাই বললেন, চিটাগাং রোডে পুলিশ, বিজিবি ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন এর মধ্যে আমাদের কর্মী খালিদ মাহমুদ সাইফুল্লাহ ভাইও আছেন। সাথে সাথে ইন্নালিল্লাহ বলে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলাম।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সেদিনের সংবাদ

পঠিত : ২৫৩৯ বার

মন্তব্য: ০