Alapon

ইবনে বতুতাঃ যার পদচিহ্ন বিশ্বের পরতে পরতে (পর্ব-২)

(গত প্রকাশের পর)

ভারত বর্ষে আগমন

সারা থেকে যাত্রা করে তিন পরে খাওয়ারিজম হয়ে হিন্দুকুশ অতিক্রম করে ইবনে বতুতা গজনি পোঁছেন। পথিমধ্যে তিনি আফগানিস্থানের  সমরখন্দ ও খুরাশানে যাত্রা বিরতি দেন। ১৩৩৩ সালের পহেলা মহরম সিন্ধুর পাঞ্জাবে পৌছেন বলে জানা যায়। সে সময় বহিরাগত কাউকে ভারতে ঢুকতে হলে সুলতানের অনুমতি নিতে হত। একই সাথে দিল্লি থেকে নির্দেশ আসত তাকে তাকে কোন শ্রেনীর পদমর্যাদা দেওয়া হবে।

ইবনে বতুতার আগমন বার্তা সিন্ধের রাজধানী মুলতানের গভর্নরের কাছে এবং দিল্লির বাদশা সুলতান মোহাম্মদ শাহ এর কাছে পাঠানো হয়। স্বাভাবিকভাবে ডাক আসতে ৫০ দিন লাগলেও  বাদশাহর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ডাক দিল্লিতে মাত্র পাঁচ দিনেই পৌছে যায়।  শেষ পর্যন্ত  ইবনে বতুতাকে  “আজিজ” (সম্মানিত) পদবি দেওয়া হল।

পাঞ্জাব পার হয়ে নলখাগড়ার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে জননী শহর হয়ে সিওয়াসিতান  পৌছান। এখানে খুরাশানের নামকরা ডাক্তার আলা আল-মুককের সাথে তার দেখা হয় এবং এ ডাক্তারের সাথেই তিনি পরবর্তীতে লাহোর পৌছান। সেখানে গভর্নরের সাথে পাঁচদিন থেকে আবোহার (Abuhar, পরবর্তীতে Abohar) হয়ে ভারতে পৌছান। 

আবোহর হল ভারতের মূল ভূ খন্ডের প্রথম শহর। সুতলতান তাকে দুটি গ্রাম থেকে রাজস্ব উত্তোলনের দায়িত্ব প্রদান করেন। বতুতার বাবা কাজী থাকায় তাকেও সুলতান মালিকি সম্প্রদায়ের কাজী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তার বেহিসেবী খরচে সুলতান বিরক্ত হন একই সাথে বতুতা সুলতানের আচরনে বিরক্ত হয়ে ভারত ছেড়ে যাবার মনস্থ করেন।

সুলতান চীনে দূত হিসেবে প্রেরণের কথা বললে তিনি রাজি হন। সুলতানের দেওয়া দুই টি জাহাজ  , কর্মচারী ও কৃতদাস যাত্রাকালীন একদল ডাকাত দ্বারা আক্রান্ত হয়ে কো রকমে প্রাণে বেচে  গুজরাটের দিকে রওনা দেন। গুজরাটে তিনি সুলতানের মূল্যবান উপটৌকোনগুলোর সুরক্ষার জন্য প্রায় পঞ্চাশ জন আবিসিনিয়ান হাবসি যোদ্ধা ভাড়া করলেন এবং কয়েকদিন যাত্রা করে অবশেষে কালিকোট বন্দরে পৌছান যেখান থেকে তার চীন যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল।

আচমকা একটি ঝড় এসে তার দু’টি জাহাজ ডুবিয়ে দিলে তার আর দিল্লি ফেরত যাবার উপায় ছিল । কিন্ত তিনি চিনে যাবার জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাই মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করেন। ভারতে ইবন বতুতা প্রায় সাত বছর অবস্থান করেছিলেন।

মালদ্বীপঃ

ইবনে বতুতা ভারত ছেড়ে মালদ্বীপে এসে প্রায় নয় মাস অবস্থান করেন। এই নয় মাসে তিনি চারটি বিয়ে করেন। চারজন স্ত্রী’র মধ্যে আবার একজন রাজপরিবারের সদস্য ছিল। মালদ্বীপে ইবনে বতুতাকে কাজী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি তার লেখা বই “রিহলা” তে মালদ্বীপ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে

এখানকার মানুষেরা অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসে এবং খালি পায়ে হাটে। মেয়েদের ব্যাপারে বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে এখানকার মেয়েরা শরিরের নিম্নাংশ সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে কিন্তু উর্ধাংশ অনাবৃত রাখে।

কাজী থাকা কালীন তিনি অনেক ইসলামী আইন চালু করতে সমর্থ হলেও মেয়েদের পোষাক নিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেন নি।মালদ্বীপে অবস্থানের শেষের দিকে ইবন বতুতার সাথে এখানকার উজিরের মনোমালিন্য দেখা দিলে তিনি সিলন (বর্তমান শ্রীলংকা) হয়ে চীন যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করেন এবং অবশেষে এ উদ্দেশ্যে একটি জাহাজে চড়ে বসেন।

শ্রীলংকাঃ

শ্রীলংকা যাবার পথে মাদুরি উপকূলে তার জাহাজ প্রচন্ড ঝড়ে প্রায় ডুবে গিয়েছিল। এই অবস্থায় ডুবন্ত জাহাজের পেছনের পাটাতনে সমস্ত রাত কাটিয়ে দিলে একদল হিন্দু তাকে উদ্ধার করে সুলতানের দরবারে পৌঁছে দেয়। মাদুরিতে ভারতের সুলতান মোহাম্মদের গভর্নরের কাছে অবস্থান করেন। তিনি গভর্নরকে মালদ্বীপ আক্রমণ করতে প্রলুব্ধ করে ইয়েমেনের উদ্দেশ্যে একটি জাহাজে চড়ে বসেন।

কিন্ত সে জাহাজটি দুর্ভাগ্যক্রমে জলদস্যু কতৃক আক্রান্ত হয়। সব হারিয়ে তিনি আবার মালদ্বীপে চলে যান। এর পরেও তিনি চিনে যাবার ইচ্ছা থেকে বিচ্যুত হন নি। তিনি মালদ্বীপ থেকে একটি চীনা বাণিজ্য যাহাজে করে চীনের উদ্দেশে রওনা দেন। টানা তেতাল্লিশ দিন যাত্রা শেষ করে  তিনি বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌছান।

ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আগমন
মালদ্বীপ থেকে বাংলাদেশে আগমন নিয়ে ইবনে বতুতা নিজেই বলেনঃ

টানা তেতাল্লিশ রাত সাগরে কাটিয়ে অবশেষে আমরা বাংলাদেশ পৌছালাম। সবুজে ঘেরা বিশাল এক দেশ, প্রচুর চাল পাওয়া যায়। অন্য সব জিনিষও এত সস্তায় পাওয়া যায় সে দেশে যে এরকম আর কোথাও দেখি নি। তবে দেশটির আর সবকিছু হতাশাব্যাঞ্জক। খুরাশানের (বর্তমান আফগানিস্তান) লোকেরা দেশটিকে বলে “প্রানপ্রাচুর্যে ভরা জাহান্নাম”

ইবনে বতুতা ১৩৪৬ সালের ৯ জুলাই বাংলায় প্রবেশ করেন। তিনি প্রথমে যে শহরে প্রবেশ করেন তার উল্লেখ করেন সাদকাঁও বা চাটগাঁও। সেখান থেকে তিনি এক মাসের পথযাত্রায়  কামারু বা কামরুপ পার্বত্য অঞ্চলে গমন কর সুফিসাধক শেখ জালাল উদ্দিনের (হযরত শাহজালাল র.) সাথে দেখা করেন। ইবনে বতুতা শেখ জালালউদ্দিনের জীবনাচরণ ও কর্মধারার বিবরণ দিয়েছেন।

তিনি দরবেশের দৈহিক গঠন, বয়স, তাঁর প্রতিদিনের আহার ও পরিধেয় বস্ত্র, অভ্যাস ও জীবনধারা, তপস্যা ও কৃচ্ছ্বসাধন, আধ্যাত্মিক শক্তি ও কেরামত, তাঁর আতিথেয়তা, সাফল্য ও জনপ্রিয়তা এবং তাঁর দরগাহের পারিপার্শিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। তার পর তিনি নদী পথে সুনুরকাঁও বা সোনারগাঁও যাত্রা করেন। ১৫ দিনে তিনি সোনারগাঁও শহরে এসে পৌঁছান। সোনারগাঁ থেকে একটি চীনা জাহাজে করে তিনি জাভার উদ্দেশে রওনা হন।

সাদকাঁও (চট্টগ্রাম) শহরে আসার পর থেকে সুনুরকাঁও (সোনারগাঁ) ত্যাগ করে জাভার উদ্দেশে রওনা হওয়া পর্যন্ত সময়কালে  ইবনে বতুতার বাংলা সফরের মেয়াদ ছিল দুই মাসেরও কম সময় (১৩৪৬ সালের জুলাই ও আগস্ট মাস)। বাংলা ভ্রমণের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও নদীর নাম উল্লেখ করেন। স্থানগুলো হলো সাদকাঁও, কামারু, হবঙ্ক ও সুনুরকাঁও এবং নদী গঙ্গা, যুন ও আন-নহর উল-আয্রাক।



সাদকাঁও বা চাটগাওকে  তিনি বলেছেন বিশাল সমুদ্র উপকূলবর্তী বিশাল শহর। এর কাছাকাছিই গঙ্গা ও যুন নদী মিলিত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে।

কামারুকে (কামরূপের অসম্পূর্ণ প্রকাশ) বর্ণনা করা হয়েছে চীন থেকে তিববত পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল পার্বত্য অঞ্চল হিসেবে।তাঁর বর্ণনায়ই আমরা প্রথম কামরূপের অধিবাসীদের যাদুবিদ্যা ও সম্মোহনী মন্ত্রতন্ত্র চর্চা এবং এ বিদ্যায় তাদের নৈপুন্য ও অনুরক্তির উল্লেখ পাই। ইবনে বতুতা কামারু নামে  যে স্থানটি পরিদর্শন করেন সম্ভবত তা ছিল খাসিয়া, জৈন্তিয়া ও ত্রিপুরা পাহাড় বেষ্টিত আসামের অন্তর্গত শ্রীহট্ট বা সিলেট অঞ্চল। এখানেই তিনি হযরত শাহজালাল (র.) এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। 

ইবনে বতুতা হবঙ্ককে বর্ণনা করেছেন আন-নহর উল-আয্রাকের তীরবর্তী একটি অতি সমৃদ্ধ ও সুদৃশ্য নগররূপে। এই হবঙ্ক শহরকে সিলেটের পূর্বদিকে অবস্থিত ভাঙ্গারূপে শনাক্ত করা যায়। ইবনে বতুতা বর্ণিত এ শহরের ধ্বংসাবশেষের কোনো হদিস পাওয়া যায় নি। ঐতিহাসিক নগরী সোনারগাঁকে (সুনুরকাঁও) বলা হয়েছে একটি সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য নগর। তিনি তার বর্ণনাতে লক্ষ্ণোতি রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন কিন্ত তিনি সে রাজ্য ভ্রমণ করেন নি।

ইবনে বতুতা তাঁর বর্ণ্নাতে  তিনটি নদীর নাম উল্লেখ করেছেন। নদীগুলো হল গঙ্গা, যুন ও আন-নহর উল-আয্রাক। তাঁর বর্ণনায় গঙ্গা ও যুন নদী সাদকাঁওয়ের নিকটে মিলিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। বর্ণনা অনুসারে দু”টি নদি যে  আজকের পদ্মা ও যমুনা নদী সেটি বুঝা যায়।গঙ্গা নদীর বর্ণনায় ইবনে বতুতা পবিত্র নদী হিসেবে এর গুরুত্ব এবং নদীতে হিন্দুদের তীর্থস্নানের উল্লেখ করেছেন।

আর উল্লেখিত নহর-উল-আয্রাক (নীল নদী) হবঙ্ক শহরের নিকট দিয়ে প্রবাহিত এবং যে নদীপথে বাঙ্গালাহ ও লক্ষ্ণৌতি রাজ্যে পৌঁছানো যায়, সেই নীলাভ জলের নদীকে স্পষ্টতই সুরমা রূপে চিহ্নিত করা যায়। আর এই সুরমা নদীপথে লক্ষ্ণৌতি রাজ্যে যেমন পৌঁছানো যায় তেমনি পৌঁছানো যায় সোনারগাঁয়ে।

ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে তখনকার বাংলার জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। বাংলার সুদৃশ্য শ্যামল সবুজ প্রান্তর, পল্লীর ছায়াসুনিবিড় সবুজের সমারোহ তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে, তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে মন্তব্য করেছেন,

‘আমরা পনের দিন নদীর দুপাশে সবুজ গ্রাম ও ফলফলাদির বাগানের মধ্য দিয়ে নৌকায় পাল তুলে চলেছি, মনে হয়েছে যেন আমরা কোনো পণ্যসমৃদ্ধ বাজারের মধ্য দিয়ে চলছি। নদীর দুই কূলে জমিতে জলসেচের পানি কল, সুদৃশ্য গ্রাম ও ফলের বাগান, যেমনটি রয়েছে মিশরের নীলনদের দুই তীরে।’

জীবন ধারনের জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর পর্যাপ্ততা আর মনভুলানো প্রাকৃতিক দৃশ্য বাংলাকে বসবাসের জন্যে আকর্ষনীয় করে তুললেও কুয়াশাচ্ছন আবহাওয়া , মেঘাচ্ছ আবহাওয়া, গুমোট আবহাওয়া, ভ্যাপসা গরম বিশেষত গ্রীষ্মকালে নদ-নদী থেকে উটাহ দাবদাহ এতটাই পীড়াদায়ক ছিল যে একে ‘দোজখ-ইপুর নিয়ামত’ অর্থাৎ প্রাচুর্যপূর্ণ নরক বলে অভিহিত করে।

ইবনে বতুতার বিবরণ থেকে আমরা তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক অবস্থার কথা জানতে পারি। তিনি তখনকার বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহকে একজন খ্যাতিমান শাসক হিসেবে প্রশংসা করেছেন । ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন সে  সময় এ সম্রাট বহিরাগতদের বিশেষত ফকির ও সুফি দরবেশদের পছন্দ করতেন। ইবনে বতুতা সোনারগাঁয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ও লক্ষ্ণৌতির সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহের মধ্যকার তীব্র সংঘর্ষের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছেন।

বতুতা সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের সময় থেকে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ও আলাউদ্দিন আলী শাহের ক্ষমতা লাভের সময় পর্যন্ত বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাপটের বিবরণ দিয়েছেন। ইবনে বতুতা এ জন্য প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য যে, নিজে সুলতান মুহম্মদ তুগলকের একজন দূত হয়েও তিনি ফখরুদ্দিনকে দিল্লির সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে অবজ্ঞা করার মতো মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন, এবং স্পষ্টভাবেই  তাঁকে উন্নত চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারীরূপে বর্ণনা করে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।

চলবে......

পঠিত : ৮৯২ বার

মন্তব্য: ০