Alapon

ইবনে বতুতাঃ যার পদচিহ্ন বিশ্বের পরতে পরতে (শেষ পর্ব)

(গত প্রকাশের পর)

আমরা গত সংখ্যায় ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আগমণ সম্পর্কে জেনেছিলাম, আলোচনা সেখানে শেষ হয় নি। তাই আমরা আজ এই সিরিজের শেষ পর্বে বাংলাদেশে আগমণের বাকি অংশ এবং অন্যান্য বিষয়াবলীও জানতে চেষ্টা করবো।

ইবনে বতুতার চোখে বাংলা

ইবনে বতুতা তার বিবরনীতে বাংলার কতিপয় সামাজিক বিষয়ের উপর  দৃষ্টিপাত করেন। সে সময়  হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকের উপর সুফি-দরবেশদের প্রভাবের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।দেশের মুসলিম ও অমুসলিম অধিবাসীরা শেখ জালালউদ্দিনের খানকায় সমবেত হতো, দরবেশের সাক্ষাৎ গ্রহণ করত, এবং তাঁর জন্য নজর-নেওয়াজ নিয়ে আসত বলে ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছেন।

প্রাপ্ত এই উপহার সামগ্রী দিয়েই দরগায় আগত ফকির ও মুসাফিররা জীবন ধারণ করত। সুলতানের আদেশ অনুসারে নদী পারাপারের জন্য সাধক ফকিরদের কোনো অর্থ প্রদান করতে হত না। স্থানীয় জনগণের কর্তব্য নির্ধারিত ছিল ফকির দরবেশদের বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করা। ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন সে সময় রাষ্ট্রীয় নির্দেশ মতে এমন রেওয়াজ ছিল যে, কোনো ফকির দরবেশ কোনো শহরে পৌঁছলে তাকে অর্ধ দীনার ভাতা প্রদান করতে হতো !
 
ইবনে বতুতার বিবরণ থেকে তখন বাংলায় দাসপ্রথার প্রচলনের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর মতে, এখনকার খোলা বাজারে পণ্য বিক্রির মত তখন খোলাবাজারে দাস দাসী বেচাকেনা হতো।এ বাজারের দ্রব্যমূল্যের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, উপপত্নী হিসেবে ব্যবহারের যোগ্য এক সুন্দরী তরুণী বাজারে তাঁর সামনে এক স্বর্ণমুদ্রায় বিক্রি হয়েছে। তিনি নিজে প্রায় অনুরূপ মূল্যে আশুরা নামীয় এক যুবতী দাসী ক্রয় করেন।

ইবনে বতুতা তার বিবরনে সে সময়কার বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বর্ণনা করেন।বাংলায় খাদ্যশস্যের এর প্রাচুর্য এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্যের সস্তা দর উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, পণ্যের এমন প্রাচুর্য ও সস্তা দর তিনি পৃথিবীর আর কোথাও দেখেন নি। তিনি দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসার প্রসার এবং বাংলার জনগনের বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কের বর্ণনাও প্রদান করেছেন।

তিনি নদীতে মানুষবাহী  ও ব্যবসায়ের পণ্যবাহী অসংখ্য নৌকা চলাচল করতে দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। নদীর তীরে বাজারগুলোর অবস্থানের কথা বর্ণনা করেছেন  এবং সোনারগাঁ নদী বন্দরে জাভা অভিমুখে যাত্রার জন্য অপেক্ষমান নোঙ্গর করা একটি বৃহৎ চীনা জাহাজের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মালয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে এ দেশের  ধানচালের ব্যবসায়ের কথাও উল্লেখ করেন।

ইবনে বতুতা বলেছেন, নদীতে পণ্য বোঝাই প্রতিটি নৌকায় একটি করে ঢাক রাখা হতো। দু’টি পণ্য বোঝাই নৌকা রাতে পরস্পরের কাছাকাছি এলে নৌকার মাঝিমাল্লারা ঢাক পিটিয়ে পারস্পরিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করত। নৌকায় ঢাক বাজানোর এ রীতি সম্ভবত তখন ছিল দেশিয় বাণিজ্য-তরীর পরিচয় শনাক্তকরণের একটি সংকেত এবং নদীতে সম্ভাব্য জলদস্যুতা প্রতিরোধের উপায় হিসেবে ভিনদেশী বা আগন্তক নৌকা চিহ্নিত করণের একটি কৌশল।

ইবনে বতুতা বাংলা ভ্রমণের সময় এ দেশে নিত্য ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রীর বাজার মূল্যের একটি তালিকা তুলে ধরেছেন। পণ্য দ্রব্যের এ মূল্য তালিকা তিনি  বাজার সরেজমিন করে তৈর করেছেন। ইবনে বতুতা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেছেন দীনার ও দিরহামে এবং পণ্যের ওজন নির্ধারণ করেছেন দিল্লির ‘রতল’ পরিমাপের ভিত্তিতে। ইবন বতুতার বর্ননায় পাওয়া যায় মাত্র এক দিরহাম দিয়ে তখন বাংলাদেশ আটটি স্বাস্থবান মুরগী পাওয়া যেত, এছাড়াও এক দিরহামে পনেরোটা কবুতর, দুই দিরহামে একটি ভেড়া পাওয়া যেত। তবে এখনকার মুদ্রা  সাথে তুলনা করে নিন্মরুপ চার্ট পাওয়া যায়।



চীন

ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যাত্রা করে প্রায় চল্লিশ দিন পর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা উপকূলে পৌছেন। তিনি সেখানকার সূলতান আল-মালিক আজ-জহিররের কাছে  প্রায় দুই সপ্তাহ কাটান । এর পরে সূলতান তাকে চীন যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সহ একটি ছোট জাহাজের ব্যবস্থা করে দেন।ইন্দোনেশিয়া থেকে  যাত্বরা করে তুতা  প্রায় চল্লিশ দিন পরে  ১৩৪৫ সালে বর্তমান চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের কুয়ানজু (Quanzhou) বন্দরে পৌছান। 

ইবনে বতুতা তার বর্ণনাতে উল্লেখ করেন যে তখনকার কুয়ানজুবাসীরা হুবহু মানুষের প্রতিকৃতি আকতে পারত। সে দেশের সুলতানের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় যখন তিনি স্থানীয় একটি বাজারের ভেতর দিয়ে অতিরক্রম করার সময়  এক চিত্রকরের দ্বারা নিজের একটি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে নেন।

সূলতানের সাথে দেখা করে ফেরার পথে তিনি দেখতে পান যে তাঁর এবং তাঁর সাথীদের প্রতিকৃতি শহরের দেয়ালে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। পরে তিনি জানতে পারলেন যে শহরে কোন আগন্তুক আসলেই তার প্রতিকৃতি এভাবে টাঙিয়ে রাখা হয় যাতে করে সেই আগন্তুক কোন অপকর্ম করে পালিয়ে যেতে না পারে।

ইবন বতুতার বর্ণনায় চীনের স্থাপত্য এবং শিল্পকলায় পরিপূর্নতার নিদর্শন পাওয়া যায়। বতুতা চীনের চিত্রকলার অনেক প্রশংসা করেন।  কিন্তু চীনের খাদ্যাভ্যাস তাঁর বিন্দুমাত্র উপভোগ্য মনে হয়নি। চীনে অবস্থানকালে তিনি বেইজিংএর গ্রান্ড ক্যানেল, ইয়াজুজ ও মাজুজ অংশে ভ্রমণ করেন। চীনের অনেক প্রশংসা করলেও চীন যে তাকে কোনভাবেই আকর্ষন করতে পারে নি তার বর্ণনা পাওয়া যায় তার উক্তি থেকেই –

কেন যেন চীন নামের দেশটি আমাকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হল। দুঃখ হল এত বিশাল একটি দেশ বিধর্মীদের কবজায় আটকা পড়ে আছে বলে। যখনই আমি বাসার বাইরে যেতাম, খেয়াল করতাম কোনদিকে কোনরকম বিদ্রোহের আভাস পাওয়া যায় কি না, তারপর হতাশ হয়ে ফিরে আসতাম। দরজা বন্ধ করে নিজেকে ভিতরে আটকে রাখতাম। একান্ত প্রয়োজন না হলে বাইরে বের হতাম না।

অবশেষে ১৩৪৬ সালে তিনি তার দেশ মরক্কো যাওয়ার উদ্দেশে সূলতানের দেওয়া একটি জাহাজে করে কুয়ানজু থেকে পশ্চিম দিকে রওনা দেন।

স্বদেশ মরক্কোতে প্রত্যাবর্তন

কুয়ানজু থেকে তিনি ভারতবর্ষ হয়ে মরোক্কোর পথে রওনা দেন ১৩৪৬ সালে। জাহাজে করে দু মাসে  তিনি সুমাত্রা পৌছান। সেখানে দুই মাস অবস্থান করে তিনি কাওলাম (ইতিহাসবিদদের মতে এটা বর্তমান মিয়ানমারের কোন বন্দর) বন্দর হয়ে তিনি ১৩৪৭ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে ভারত পৌছান।

ভারতে অবস্থান না করে  ফেরার পথে আরো একবার মক্কায় হজ্জ্ব করার চিন্তা করেন ।ভারত থেকে অন্য একটি বাণিজ্যিক জাহাজে চড়ে ভারত মহাসাগর হয়ে তিনি মাসকাটের দিকে যাত্রা করেন। মাসকট থেকে হরমুজ প্রণালী হয়ে সিরাজ, ইস্পাহান হয়ে ১৩৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে বাগদাদ পৌছান।

১৩৪৮ সালের শুরুতে তিনি সিরিয়ার  দামেস্কে আসেন। দামেস্কে স্থানীয় জাহিরিয়া একাডেমিতে তার সাথে মরোক্কোর তাঞ্জিয়ারের এক বিখ্যাত শেখের সাথে দেখা হয়ে যায়।ইবন বতুতা শেখের কাছ থেকে জানতে পারেন যে তার বাবা পনেরো বছর আগে মারা গেছেন তবে তার মা এখনও বেঁচে আছেন।

এ সময় সিরিয়া এবং গাজায় কালা জ্বরের মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। ইবন বতুতা স্থানীয় কাজীর কাছ থেকে তথ্য পানে যে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা ২৪০০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বতুতা যখন হেবরন আর গাজা পৌছালেন তখন দেখলেন যে মহামারীর প্রকোপ কিছুটা কমে প্রতিদিন গড়ে ১১০০ তে নেমে এসেছে। এই মহামারী থেকে বাঁচতে ইবন বতুতা প্রতিদিন রোজা রাখতেন।

সেখান থেকে কায়রোতে যেয়ে সেখানেও দেখলেন মহামারী থামেনি। ইবন বতুতা কায়রো পৌছানোর আগে এখানে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা ২১,০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে জানতে পারেন।কায়রো থেকে মিশরের সাঈদ বন্দর হয়ে ১৩৪৮ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি মক্কা পৌছান। ১৩৪৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত হজ্জ্ব সেরে তিনি ফেজ হয়ে ঐ বছরেই তার নিজ দেশ তাঞ্জিয়ার পৌছান। তাঞ্জিয়ার পৌছে তিনি দেখতে পান যে তার মা ও পরলোক গমন করেছেন।

আল-আন্দুস, স্পেন ও উত্তর আফ্রিকা ভ্রমণ

ইবনে বতুতা তার নিজের শহর তাঞ্জিয়ারে পৌছে তিনি আসুস্থ হয়ে পড়েন।তিনি  প্রায় তিন মাস শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর বতুতা সূলতানের অনুরোধে যুদ্ধে (জিহাদে) অংশগ্রহন করার জন্য রক্ষি বাহিনীতে যোগ দেন এবং সৈন্যবাহিনীর সাথে জাহাজে চড়ে স্পেনের আন্দালুসিয়ায় পৌছান।

সে সময় স্পেনের খৃষ্টান শাষক আডফুনাস (Alfonso XI) দশ মাস ধরে জোবেল (জিব্রাল্টার) দখল এবং অবরোধ করে রেখেছিলেন।  আডফুনাস মনে করেছিনে যে অবরোধ করে রাখলে হয়তো মুসলিমরা পরাজিত হবে এবং দুর্গের সকলকে একসাথে বন্দি করা যাবে।

কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আডফুনাস নিজেই কালাজ্বরে আক্রান্ত হন এবং পরে মারা যান। আডফুনাস মারা যাওয়ায় মুসলমানদের আর যুদ্ধ করা লাগে নি। ইবনে বতুতা স্পেনের স্পেনের ভ্যালেনসিয়া এবং গ্রানাডা ঘুরে দেখেন।

স্পেনে থেকে স্বদেশে ফিরে ইবন বতুতা আফ্রিকা যাবার মনস্থ করেন। তিনি আফ্রিকার এমন কিছু অঞ্চল পরিদর্শন করার ইচ্ছা পোষন করেন যেগুলো মুসলিম অধ্যুষিত কিন্তু তার এখনও সেগুলোতে যাওয়া হয় নি।তিনি প্রথমে মরক্কো যান যা তখনকার মহামারীতে জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। জনশূন্য হওয়ায় মরক্কোর রাজধানী ফেজ শহরে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।

মালি ও সাহারা মরুভূমি

প্রায় সব মুসলিম অঞ্চল ভ্রমণের  তার পর আর একটি মাত্র মুসলিম দেশ ভ্রমণ বাকি ছিল, সেটি হল নিগ্রোল্যান্ড। ইবন বতুতা ১৩৫১ সালের বসন্তে  সাহারা মরুভুমির উত্তরে সিজিলমাসার উদ্দেশ্যে ফেজ নগরী ত্যাগ করেন। সিজিলমাসাতে তিনি প্রায় চার মাস কাটান। সেখান থেকে ১৩৫২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি লবণের খনির শহর তাঘাজার (Taghaza) উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

প্রায় পঁচিশ দিনের পথ পারি দিয়ে আঘাজায় পৌঁছান।   ইবন বতুতার বিবরণ থেকে জানা যায়  সেখানকার ঘরবাড়ি এবং মসজিদগুলো লবণের ব্লক দিয়ে তৈরী আর ছাদগুলো  উটের চামড়া দিয়ে তৈরী।  এ অঞ্চলে তেমন  গাছপালা নেই আর এখানকার পানি ছিল অত্যন্ত লবণাক্ত ছিল।



তাঘাজাতে প্রায় দশদিন অবস্থানের পর ইবন বতুতা সাহারা মরুভূমি পার হবার সিন্ধান্ত নেন। প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তিনি তাসারাহলার একটি মরূদ্যানে তিন দিন অবস্থান করেন এবং মরুভূমি পাড়ি দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত রসদ ও পানি সংগ্রহ করেন। তাসারাহলা থেকে যাত্রা শুরু করে আওয়ালাতায় একবার যাত্রাবিরতি দিয়ে ট্রান্স সাহারান বাণিজ্য রুটের দিকে রওনা দেন। সিজিলমাসা থেকে এই রাস্তায় প্রায় ১৬০০ কিঃমিঃ সাহারা মরুভূমি পার হতে তার প্রায় দুই মাস লাগে।

অবশেষে তিনি নাইজার নদীর তীরে মালি রাজ্যে পৌঁছান। তখন সেখানকার সুলতান ছিল মানসা সুলায়মান যিনি কৃপনতার জন্যে কুখ্যাত ছিলেন। তবে এখানকার  স্থানীয়দের আতিথিওতা ইবন বতুতার কাছে মনমুগ্ধকর ছিল।  ইবন বতুতার বর্ননা মতে মালির লোকজন ধর্মভীরু হলেও এখানকার নারীরা ইসলামী পর্দাপ্রথা মেনে চলত না। তারা সকলেই এমনকি সুলতানের কন্যারাও সকলের সামনে বিবস্ত্র হয়ে চলাফেরা করত।

ইবন বতুতা মালিতে প্রথম জলহস্তির দেখা পান। আট মাস পরে তিনি কাফেলা নিয়ে তিম্বুক্তের দিকে যাত্রা করেন। সেখান থেকে গাঁও শহরে চলে আএন। গাঁও শহরে পৌঁছে তিনি মরক্কোর রাজার ফিরতি আদেশ পত্র পান । পত্র পাওয়া মাত্র তিনি ১৩৫৩ সালের সেপ্টেম্বরে মরক্কোর উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করে করে ১৩৫৪ সালের শুরুর দিকে তার প্রিয় জন্মভূতিতে পৌঁছান।

ইবনে বতুতার গ্রন্থ

মরক্কোর রাজধানী ফেজ এ পৌঁছে ইবন বতুতা সুলতান ও তার সভাসদদের কাছে তার সমস্ত ভ্রমণ কাহিনী  বর্ণনা করেন। তার সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইবন খালদুনের  মতে সভাসদ বতুতার কথা বিশ্বাস করে নি। তব সভাসদের প্রভাব শালী একজন উজির তার কথা বিশ্বাস করেছিল। সুলতান উজিরের চাপে পড়ে তার একজন একান্ত সচীব ইবন জুজাইকে ইবন বতুতার ভ্রমণ কাহিনী লিখার আদেশ প্রদান করেন। শুরু হল বল ও লিখার পর্ব।

তবে ইবন জুজাই ইবন বতুতার বর্ণনা হুবহু লিপিবন্ধ করেন নি। তার সম্পাদনায় অনেক ক্ষেত্রেই ত্রুটি ছিল । লেখার ধরন সাধারণ কিন্তু তার মধ্যে কিছু স্থানে কবিতার ছত্র যোগ করে লেখায় বৈচিত্র আনতে চেষ্টা করেছেন। কোথাও কোথাও আবার নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথাও জুড়ে দিয়েছেন।

ইবন জুবাইর নামে আন্দালুসিয়ার এক পণ্ডিত দ্বাদশ শতাব্দীতে মিশর, হিজাজ, সিরিয়া এবং পূর্বের বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ইবন বতুতার যে সকল ভ্রমণ পথ ও বর্ণনা ইবন জুবাইরের সাথে মিলে যায় সে জায়গায় ইবন জুজাই নতুন কোন কাহিনী না লিখে ইবন জুবাইরের ভ্রমণের বর্ণনাই তুলে ধরেছেন  !

অবশেষে ১৩৫৫ সালের ৯ই ডিসেম্বর মৌখিক বর্ণনা শেষ হলে “রিহলা” নামক বইটি লিপিবদ্ধ করার কাজ শেষ হয়। রিহলা কথাটির সারমর্ম হল “মুসলিম সম্রাজ্য, এর শৌর্য, শহর এবং এর গৌরবান্বিত পথের প্রতি উৎসাহিদের জন্য একটি দান” (A Gift to Those Who Contemplate the Wonders of Cities and the Marvels of traveling” আরবি:”تحفة النظار في غرائب الأمصار وعجائب الأسفار‎ “)।
ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনী সম্বলিত এ গ্রন্থের পুরো নাম তুহফাতুন-নুজ্জার ফি গারাইবিল আমসার ওয়া আজাইবিল আস্ফার।

ইবন জুজাই এর মতে ইবন বতুতা নিজেই বলেছেন “আল্লাহর রহমতে সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণের মনঃকামনা পূর্ণ হয়েছে যেটা কোন সাধারণ মনুষের পক্ষে সম্ভব না।” বইয়ের শেষে ইবন জুজাই যোগ করেন

এখানে শেষ হল সফর বর্ণনার, যেটাকে আমি শেখ আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবন বতুতার বয়ান থেকে কিছুটা সংক্ষেপিত করে লিপিবদ্ধ করেছি। যে কোন বোধসম্পন্ন মানুষ সহজেই বুঝবেন তিনি ছিলেন যুগের পরিব্রাজক। যদি কেউ বলেন যে তিনি ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের পরিব্রাজক তাহলে তিনি একটুও বাড়িয়ে না বলার দায়ে অভিযুক্ত হবেন।

এই বইটিকে ১৪শ শতকের পূর্ব, মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৫৮ সালে এ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ বের হয়।

উপসংহার

ইবনে বতুতা  সর্বকালের সেরা পর্যটকদের একজন।তিনি ৩০ বছরে প্রায় ৪০ টি দেশ ভ্রমণ করেন।  অনেকে মার্কো পালোকে তার সমকক্ষ মনে করেন। তবে মার্কো পালোর চেয়ে ইবনে বতুতা বেশি অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন। এ কারনে  অধিকাংশ ইতিহাসিবিদ ইবনে বতুতাকেই বিশ্বের সেরা ভ্রমণকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এই মহান পর্যটক ১৩৬৮ মতান্তরে ১৩৭৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন ।

সমাপ্ত

তথ্য ও ছবিঃ উইকিপিডিয়া , অনলাইন পোর্টাল

পঠিত : ১১৬২ বার

মন্তব্য: ০