Alapon

১৫ বছর পর আবারও পার্লামেন্টে, কী চান মাহাথির?



মাহাথির মোহাম্মদ। এই একটি নাম প্রার্থী তালিকায় যুক্ত হওয়ার পর থেকেই পাল্টে গেছে মালয়েশিয়ার আপাত নিরুত্তাপ রাজনীতি। দেশটির সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যতটুকু অনিশ্চয়তা ছিলো, সেটিও এই ৯২ বছর বয়সীর জন্য। রাজনীতির মাঠের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় মাহাথির এবার ঝুঁকি একটু বেশিই নিয়েছেন। তবে লড়াই তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়। এর আগেও দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তিনি। আবার ফিরেও এসেছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপে।

মালয়েশিয়ায় এবারের সাধারণ নির্বাচন দেশটির ইতিহাসের ১৪তম। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে রাজনৈতিক জোট বারিসান ন্যাশনাল (বিএন)। ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই জোট মালয়েশিয়া শাসন করছে। মাহাথির মোহাম্মদও এই জোটের অংশ ছিলেন। ক্ষমতায়ও এসেছিলেন, ছিলেন সবচেয়ে বেশি সময় ধরে।



দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সফল রাষ্ট্রনায়ক মনে করা হয় তাঁকে। অথচ রাজনীতির মঞ্চে ফিরেই নিজের দল ও একসময়ের শিষ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন মাহাথির। তাঁর বক্তব্য, যে রাজনৈতিক দল দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়, সেই দলে থাকা লজ্জার। আর তাই বিরোধী পক্ষের হয়ে পুরো দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছেন মাহাথির মোহাম্মদ।

বুধবার দেশটিতে সাধারণ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। গত নির্বাচনের চেয়ে ভোট এবার কম পড়েছে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে প্রায় ৮৫ শতাংশ ভোটার তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। সিঙ্গাপুরভিত্তিক দ্য স্ট্রেইটস টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, এবার ভোট দিয়েছে ৭৬ শতাংশ ভোটার। অনুমিত এই সংখ্যা কিছুটা কমবেশি হতে পারে। তবে তা গতবারের সংখ্যাকে ছাপিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে মোট ২২২টি আসন আছে। বিরোধীদলীয় জোট পাকাতান হারাপান বলছে, সরকার গঠন করতে তাদের দরকার ১১২টি আসন। এর আগে ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে পপুলার ভোট বেশি পেয়েছিল এই জোট। এবার মাহাথিরের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে পার্লামেন্টের ১২১টি আসন জিতে নেয় তারা। 

মাহাথির মোহাম্মদ নিজের আসনে জয়ী হয়েছেন। ক্ষমতা ছাড়ার ১৫ বছর পর ফের পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করবেন মালয়েশিয়ার এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

মাহাথিরের উত্থান যেভাবেঃ

মালয়েশিয়ায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পর প্রথমবারের মতো দেশটিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে দেন তিনি। এই একটি কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার অনুকরণীয় রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন মাহাথির। যদিও নিজ দেশে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।

রাজনীতিতে মাহাথির মোহাম্মদের হাতেখড়ি ১৯৪৬ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল মোটে ২১ বছর। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তখন উত্তাল মালয়েশিয়া। ওই সময়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন তিনি। ওই দলের মূল আদর্শ ছিল জাতীয়তাবাদ। এটি এখনো মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল।

ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন মাহাথির। এরপর জন্মভূমি কেদাহ রাজ্যে সাত বছর চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। মাহাথির ধীরে ধীরে ‘ডক্টর এম’ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ইউএমএনও দলের হয়ে ১৯৬৪ সালে মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।

তবে ১৯৬৯ সালে ঘটে ছন্দপতন। দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পার্লামেন্ট আসন হারান তিনি। মালয় সম্প্রদায়কে অবহেলার অভিযোগ তুলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টুংকু আব্দুল রহমানের কাছে খোলা চিঠি লিখেছিলেন মাহাথির। এতেই ক্ষমতাসীন দলের রোষের মুখে পড়েন তিনি।



রাজনৈতিকভাবে একঘরে হওয়ার পর বই লেখায় মনোনিবেশ করেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। নিজের আদর্শ ও চিন্তাভাবনা নিয়ে একটি বিতর্কিত বই লেখেন তিনি। বইটির নাম ছিল ‘দ্য মালয় ডিলেমা’। ওই বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই মালয় সম্প্রদায়কে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছিল। আর এই বিষয়টি মেনে নিতে মালয় সম্প্রদায়কে বাধ্য করা হয়েছিল।

দ্য মালয় ডিলেমা প্রকাশিত হওয়ার পর রাজনীতিবিদ হিসেবে ডক্টর এমের পুনরুত্থান ঘটে। পশ্চিমা নব্য ঔপনিবেশিকদের প্রতি মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে-তা ঠিক করতে বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইউএমএনও দলের তরুণ নেতাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মাহাথির। দলে ফিরেই ১৯৭৪ সালে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন তিনি। এরপর মন্ত্রিসভায় ঢুকে যান মাহাথির। পান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।

মন্ত্রী হওয়ার চার বছরের মধ্যে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন মাহাথির মোহাম্মদ। ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) দ্বিতীয় প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মাহাথির।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ‘ডক্টর এম’ দেশ নিয়ে তাঁর চিন্তাগুলোর বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ শুরু করেন। জাপানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি মালয়েশিয়াকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, স্টিল ও গাড়ির উৎপাদক দেশে পরিণত করেন। অথচ এর আগে মালয়েশিয়া শুধু রাবার ও টিন রপ্তানি করত। টানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। এই দীর্ঘ সময়ে মালয়েশিয়াকে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন তিনি। ২০০৩ সালে ক্ষমতা ছাড়েন মাহাথির।

সমালোচনা যা নিয়েঃ

দেশকে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে নিয়ে এলেও, মাহাথিরের সমালোচনাও কম হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অনেক মানুষই তাঁকে ‘বর্ণবাদী’ হিসেবে দেখেন। বিশেষ করে, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকেরা তাঁকে খুব একটা পছন্দ করেন না। মালয় সম্প্রদায়ের প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর পাশাপাশি নৃতাত্ত্বিক বৈষম্যের সূচনাও করেছিলেন মাহাথির।

সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়নের গুরুতর অভিযোগ আছে। তাঁর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানো সব ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন মাহাথির।

আনোয়ার ইব্রাহিম ছিলেন মাহাথির পরবর্তী যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। অথচ ১৯৯৮ সালে সেই আনোয়ারকেই বরখাস্ত করেন মাহাথির। পরে তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় সমকামিতা ও দুর্নীতির অভিযোগ। সেই অভিযোগে সাজা পেয়েই এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি আনোয়ার।



তবে শুধু আনোয়ার নয়, ক্ষমতা ছাড়ার পর সব উত্তরসূরির সমালোচনাতেই মুখর ছিলেন ডক্টর এম। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মাহাথিরই প্রথম নাজিবকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। নাজিব প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন তাঁর সমর্থন নিয়ে। এবার শিষ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মাহাথির বলছেন, আগে তিনি ভুল করেছিলেন! এবার সেগুলো শুধরে নিতেই ক্ষমতায় আসতে চান তিনি।

১৫ বছর পর পার্লামেন্টে...

মালয়েশিয়ার সাধারণ ভোটারদের অর্ধেকই কিন্তু মুসলিম ও মালয় সম্প্রদায়ের। তাদের ভোটের ওপরই নির্ভর করছে নাজিবের ভাগ্য। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচনের আগ দিয়ে নির্বাচনী সীমারেখা পরিবর্তন ও ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করায় কিছুটা সুবিধা পেয়েছেন নাজিব রাজাক। তবে মাহাথির মোহাম্মদকে বাতিলের খাতায় ফেলার সাহস কারও নেই। কারণ মুসলিম মালয় সম্প্রদায়ের ভোটব্যাংক ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই আছে এবং এরই মধ্যে তিনি তা দেখিয়েও দিয়েছেন।

নির্বাচনের খবর যতটুকু পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেছে, বারিসান ন্যাশনাল ও পাকাতান হারাপানের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক ফলাফল আগামীকাল পাওয়া যেতে পারে। তবে অনানুষ্ঠানিক ফলাফলে জানা গেছে, এগিয়ে আছে বিরোধীদলীয় জোট। এটি দেশটির জন্য একটি নজিরবিহীন ঘটনা।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, বারিসান ন্যাশনালের অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী এবার নির্বাচনে হেরে গেছেন। বর্তমান মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যকেও থাকতে হবে পার্লামেন্টের বাইরে। অন্যদিকে ক্ষমতা ছাড়ার ১৫ বছর পর ফের পার্লামেন্টে ঢুকছেন মাহাথির।

মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্য এবারের জাতীয় নির্বাচন পাশা খেলার শেষ দান। অন্যদিকে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন নাজিব রাজাক। মাহাথির মোহাম্মদ জিতলে তা এক ব্যক্তির জনপ্রিয়তার জয় হবে। আর যদি ‘ডক্টর এম’ হেরে যান, তবুও বলতে হবে যে, মালয়েশিয়ার একদলীয় শাসনের ভিতে বড়সড় ফাটল তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। সেই ফাটলে নাজিবের ক্ষমতার স্তম্ভ ধসে পড়া অসম্ভব কিছু নয়।

মাহাথির কী চান?

মালয়েশিয়ার বিরোধীদলীয় জোট পাকাতান হারাপান ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে। নাজিবের পতনের জন্যই একসময়ের বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ডক্টর এম। আবার এও জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচিত হলেও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকবেন না তিনি। ‘পুরোনো শত্রু’ আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতায় এনে বিদায় নেবেন। যদিও নিন্দুকদের ধারণা, ক্ষমতা পেলে বদলে যেতে পারেন এই ঝানু রাজনীতিবিদ।

ভোটগ্রহণের আগে টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, বর্তমানে মালয়েশিয়ার সাধারণ মানুষ আর্থিক সংকটে আছে। এ জন্য প্রথমে নাজিবকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তা না মানায় নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তিনি।



মনে রাখতে হবে, মাহাথির মোহাম্মদ এখন যে পরিস্থিতির বিরোধিতা করছেন, তা তাঁর নিজেরই তৈরি। মালয়েশিয়ার বর্তমান একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে তিনি শক্ত ভিত্তি দিয়েছিলেন। এখন সেটিই ভেঙে ফেলার কথা বলছেন তিনি। আর এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন নাজিবের বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির অভিযোগকে।

একটি জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশটির বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, সর্বস্তরে শরিয়া আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া রাজনীতিতেও এখন কট্টরপন্থী ইসলামি রাজনৈতিক দলের প্রভাব বেড়েছে।

টাইম ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাহাথির বলেছেন, এ ধরনের ইসলামি রাজনৈতিক দল গঠন করা সঠিক নয়। আর এই দলগুলো যেভাবে শরিয়া আইন বাস্তবায়নের দাবি তুলছে, তাও ভালো নয়। এসব দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মাহাথির।

পঠিত : ৭৪৭ বার

মন্তব্য: ০