Alapon

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ১১ মে'র খুনি মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান আজো বহাল তবিয়তে

১৯৮৫ থেকে ২০১৪।  ২৮ বছরের একটি দীর্ঘ সময়কাল। পুরো এই সময়টাই বাংলাদেশজুড়ে
বেশ আলোচিত ছিলেন প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা। যার কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিল
নানা বিতর্কের মধ্যে। শেষটাতেও বিতর্ক এড়াতে পারলেন না। লোভের আগুনে পুড়েছে
তার সেবার মনন দেশ ও দশের চিন্তা না করেই তিনি নিজের চিন্তায় ছিলেন মশগুল। 
যার পরিণতি আজ চাকুরী জীবনের শেষ বেলায় এসে তার সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুকে বিদীর্ণ করেছে।  প্রভাব এবং প্রতাপ, দুর্নীতি আর জালিয়াতি
কোনটারই অভাব ছিল না তার।  শুধু অভাব ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধার খেতাব।  সেই
খেতাব অর্জন করতে গিয়ে তিনি আজ রিক্ত।   এই
ক্ষমতাধর কর্মকর্তাটি হচ্ছেন সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান।

১৯৮৫ সালে মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান খবরের শিরোনাম
হয়েছিলেন দেশের কোরআন প্রেমিক জনতার উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে।
দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও বহাল তবিয়তেই ছিলেন তিনি। প্রায় তিন দশক
পর আবারো সংবাদের শিরোনামে আসলেন যুদ্ধ না করেই মহান মুক্তিযুদ্ধের
সনদগ্রহণ করে।  সে কারণে মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানকে নিয়ে ফের বিতর্কের সৃষ্টি
হয়।

১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল ভারতের দু’জন উগ্র
সাম্প্রদায়িকতাবাদী নাগরিক পদ্মপল চোপরা ও শীতল সিং মুসলমানদের পবিত্র
ঐশীবাণী কোরআনের সকল আরবি কপি ও অনুবাদ বাজেয়াপ্ত করার জন্য কলকাতা
হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন।

রিটে বলা হয়েছিল, কুরআনে এমন
কিছু আয়াত আছে যেখানে কাফির ও মুশরিকদের হত্যা এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের
প্রেরণা দেওয়া হয়েছে। তাই এই গ্রন্থ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে।


ওই বছরের ১২ এপ্রিল বিচারপতি মিসেস পদ্মা খাস্তগীর এই মামলা গ্রহণ করে এ
বিষয়ে ৩ সপ্তাহের মধ্যে এফিডেভিট প্রদানের জন্য রাজ্য সরকারের প্রতি
নির্দেশ দেন। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ভারতসহ সারাবিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এর
প্রতিবাদে বাংলাদেশের মুসলিম জনতাও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।


বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জেও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ১৯৮৫
সালের ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঈদগাহ ময়দানে আয়োজন করা হয় এক প্রতিবাদ
সমাবেশের। সেদিন বেলা ১১টায় সমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা
হোসাইন আহমদকে এসপি অফিসে ডেকে নিয়ে চাপ দিয়ে সভা স্থগিতের জন্য লিখিত
অঙ্গিকার নেওয়া হয়। পরে প্রশাসন নিজ উদ্যোগে সভা স্থগিত করা হয়েছে মর্মে
সভা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে মাইকিং শুরু করে।

কিন্তু তৌহিদী
জনতা প্রশাসনের অপপ্রচার ও বাধা উপেক্ষা করে দলে দলে আসতে থাকে ঈদগাহ
ময়দানের দিকে। উপায় না দেখে ঈদগাহ ময়দানে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এ
পরিস্থিতিতে মাওলানা ইসারুল হক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে শুধুমাত্র মুনাজাত
করেই সভা শেষ করে চলে যাওয়ার অনুমতি চান।

কিন্তু তৎকালীন
ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান ক্ষিপ্ত হয়ে জনতাকে গালিগালাজ করতে
থাকেন এবং কোনোভাবেই এখানে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন।


এসময় তৌহিদী জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়লে ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা
ওয়াহিদুজ্জামানের নির্দেশে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে
প্রথমেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দশম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল মতিন। হাসপাতালে
নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় শীষ
মোহাম্মদ, রশিদুল হক, অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সেলিম, সাহাবুদ্দীন, কৃষক
আলতাফুর রহমান সবুর, রিকশাচালক মোক্তার হোসেন ও রেল শ্রমিক নজরুল ইসলাম
নিহত হন। আহত হয়েছিলো আরো অর্ধশতাধিক মানুষ।

পবিত্র কুরআনের
অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী তৌহিদী জনতার উপর গুলি বর্ষণের নির্দেশ
দেওয়ায় ওই দিন ৮জন মুসল্লিকে জীবন দিতে হয়েছে। ওই ঘটনায় ধর্মপ্রাণ
মুসল্লিরা মানসিকভাবে আহত হয়েছিলেন। আলোচিত সেই মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান তখন
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।   হাসিনা  তাকে পুরষ্কৃত করে প্রমোশন দিয়েছে নানান সময়ে।  সর্বশেষ সে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব থেকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা সম্পন্ন
বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছে।

১৯৮৫ সালের ১১ মে
চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের বিচার এখনো হয়নি। এ ঘটনায়
নিহতদের পরিবারের অভিযোগের তীর মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে হলেও বিগত
২৯ বছর বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো তাকে তিরস্কার না করে
বিভিন্ন মেয়াদে পুরস্কৃত করেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের গত
আমলে দীর্ঘ সময় ধরেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ছিলেন মোল্লা
ওয়াহিদুজ্জামান। এরপর ২০১৪ সালের মধ্য জানুয়ারি থেকে প্রতিমন্ত্রীর
পদমর্যাদায় তাকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।  তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হলেও আজো সে বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।  আওয়ামীলীগ সরকার তাকে কোনভাবেই শাস্তি দিতে রাজি নয় এত অপরাধ সত্তেও।  কারণ সে পরীক্ষিত ইসলামবিরোধী।


দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান করে প্রমাণ করেছে সে একজন ভুয়া
মুক্তিযোদ্ধা।  একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েই তিনি সে মুক্তিযোদ্ধা সেজে সনদ গ্রহণ করেছেন।  দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)
মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন
মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ ও জনপ্রশাসনবিষয়ক মন্ত্রণালয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা
কাউন্সিলের (জামুকার) বৈঠকে মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানসহ চার সচিব ও একজন যুগ্ম
সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়।


চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলোচিত ওই হত্যাকান্ডের বিচারের জন্য এখনো আশায় বুক বেঁধে
অপেক্ষায় আছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা।  ৩৩ বছর পার হয়ে গেলেও বর্বরোচিত
এই হত্যাকান্ডের মূল নায়কদের শাস্তির দাবি থেকে সরে আসেনি নিহতদের স্বজনরা।

পঠিত : ৯১৩ বার

মন্তব্য: ০