Alapon

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভয়াবহ যানজটের রহস্য ও মুক্তির উপায়

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নিত্য যানজটে পরিণত হয়েছে। বিগত এক মাস ধরে যানজটটি ২০-২৫ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ থাকলেও সম্প্রতি তা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে যানজট। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে সাধারণত ৬ ঘন্টা লাগে। সেখানে ভয়াবহ যানজটের কারণে ২৬ থেকে ৩০ ঘন্টা লেগে যাচ্ছে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে যাত্রীদের অসহনীয় ভোগান্তির।

এমন ভয়াবহ যানজটের কারণ কি?
সাধারণত ঈদের কয়েকদিন আগে এমন তীব্র যানজট সৃষ্টি হতে দেখেছি। কিন্তু রোজার পূর্বেই এমন যানজটের কারণ খতিয়ে দেখা যায়- ফেনীর ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারপাসের নির্মাণ কাজ চলমান থাকায় যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। পাশাপাশি যোগ হয়েছে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, সড়কে অবৈধ পার্কিং, হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি। দাউদকান্দি টোল প্লাজা,  টানা ক’দিনের বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে পুরো এক কিলোমিটার সড়ক, কুমিল্লার পদুয়ার বাজার, কাঁচপুরসহ প্রায় ১৩টি স্থানে মহাযানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে আটকে থাকতে হয় এ পথে চলাচলকারী যাত্রীদের। যানজট নিরসনের লক্ষেই মহাসড়কটি চার লেন বিশিষ্ট করা হয়। এর পরও এ মহাসড়কে যাতায়াত নিরবচ্ছিন্ন যানজটে দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে কেন?

এ মহাসড়কে যানজট মানুষের জীবনযাত্রা স্থবির করে দিচ্ছে। প্রতিদিন যানজটে লাখো মানুষের হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। জ্বালানি অপচয় হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে ফেনীর রেলওয়ে ওভারপাসের কাজ শেষ না হওয়া, ট্রাফিক আইন না মানা, পরিকল্পনার অভাব, ফুটপাত দখল, পরিবহনের সংখ্যা স্পুটনিক গতিতে বৃদ্ধি পাওয়াও যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ। তবে সড়কে গাড়ি থামিয়ে ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজীসহ নানা অনিয়মকে দায়ী করছেন অনেকে। সড়কে যেখানে–সেখানে পার্কিং, ফুটপাত দখল করে দোকান বসানো ইত্যকার সমস্যা তো বহু পুরনো। এসব কারণে কিছুতেই ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট সমস্যার সমাধান হচ্ছে না ।

যানজট পরিস্থিতি দিনই দিনই জটিল হচ্ছে। যানজট সমস্যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ইতোমধ্যে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এত কিছুর পরও যানজট সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কার্যকর অগ্রগতি এখনো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এভাবে পথে আটকে থেকে কত কর্ম ঘন্টা খোয়াবে মানুষ?

যানজট থেকে মুক্তি চায় জনগণঃ
আসলে আমাদের দেশটার কোনো গতি নেই; আছে দুর্গতি। যানজটের যে অবস্থা তাতে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ঢাকার মানুষকে মোটামুটি কত বছর রাস্তায় আটকে থাকতে হয়? এক হিসাবে তা সাড়ে সাত বছর। অস্ট্রেলিয়ার যাত্রীরা যাতায়াতে সপ্তায় ব্যয় করেন ৩ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট। আমাদের রাজধানী ঢাকায় নাকি প্রতিদিনই লাগে কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা। ঢাকা–চট্টগ্রাম সড়কে বাড়তি সময় লাগে প্রায় ৪ ঘন্টা। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৬৮ বছর। এ হিসেবে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত যাতায়াতের সময়ের আনুমানিক যোগফল হবে কমসে কম সাড়ে সাত বছর। এটা গায়েবি গজব নয়, মনুষ্যসৃষ্ট আজাব। যানজটের এ আজাব থেকে আমরা মুক্তি চাই।

যানজট থেকে মুক্তি মিলবার উপায়ঃ
আমাদের যতটুকু সড়কপথ আছে তাতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানাবিধ পদক্ষেপ নিলে যানজট ৮০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। আমরা বিশ্বের বড় বড় শহর এমনকি হজের সময় মক্কা, মদিনা; অলিম্পিক গেমসহ নানা বড় আসরের সময় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সে সময় কত সহজেই না যানজট নিয়ন্ত্রণ করছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের এবং ঢাকা মহানগরীর যানজট, পার্কিং সমস্যা এবং জনদুর্ভোগের পরিপ্রেক্ষিতে আশু করণীয় হলো যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, সড়ক মহাসড়কে অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য জরিমানার ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন জায়গা পার্কিং তৈরি ও সময়ের মূল্যানুসারে পার্কিং ফি নেয়া, পার্কিং থেকে প্রাপ্ত অর্থ পাবলিক পরিবহনের মানোন্নয়নে ব্যয় করা। সর্বোপরি আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থার মানউন্নয়ন করা গেলে যানজট নিরসন সম্ভব।

কোথায় কোথায় হচ্ছে যানজটঃ
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় যাত্রাবাড়ী–গুলিস্তান ফ্লাইওভার থেকে নামার পরই যানজটের শিকার হতে হয়। শনির আখড়া থেকে কাঁচপুর ব্রিজ এবং কাঁচপুর ব্রিজ থেকে মেঘনা ব্রিজ পর্যন্ত ৩০ মিনিটের পথ যেতে ৬ ঘণ্টার বেশি সময় লাগছে। এর ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বিশেষ করে সপ্তাহের ছুটির দিন বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই শুরু হয় প্রচণ্ড যানজট যা শুক্রবার ও শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত থাকে বলে হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা জানান। এছাড়া সড়কের বিভিন্ন স্থানে সংস্কারের নামে রাস্তা কেটে রাখার কারণে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের।

এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর এলাকায় প্রায় ৮০ মিটার সড়ক খুঁড়ে রাখা হয়েছে কয়েকদিন থেকে। এর ফলে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ থেকে কুমিল্লার দাউদকান্দি পর্যন্ত প্রায় ৩৩ কিলোমিটার অংশজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া মহাসড়কের কুমিল্লার অংশের দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে শহীদনগর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়কে প্রতিদিনই শত শত যানবাহন যানজটে আটকে থাকে। এদিকে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর ও মোগরাপাড়া এলাকায় সড়ক সংস্কার কাজের কারণেও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মহাসড়কের দু’পাশে হাজার হাজার গাড়ি আটকে থাকতে হয় দীর্ঘসময়। ফেনীতে ওভারপাসের নির্মাণের কাজের জন্য নিয়মিত ২ থেকে ৩ ঘন্টা জ্যামে পড়তে হচ্ছে। ফেনী থেকে ঢাকার দুরত্ব ১৫৫ কিলোমিটার। ফেনী থেকে ঢাকার এ দূরত্ব অতিক্রম করতে অতীতে সাধারণত সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা সময় লাগার কথা। যানজটের কারণে এখন সময় লেগেছে ১২ থেকে ১৫ ঘন্টা।

ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের শাস্তি নিশ্চিত হচ্ছে না কেন?
রাতদিন মেঘনা এবং দাউদকান্দি ব্রিজে জানজট লেগেই থাকে। ব্রীজের আগে পরে ট্রাকের পার্কিং সহজেই চোখে পড়ে। সড়কের পাশে কোনভাবেই ট্রাক–কাভার্ড ভ্যান দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধের শাস্তি কি কেউ পায়? এটি প্রয়োগের দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের। কখনো কি তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করেছেন? ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে গাড়ি অবাদে চলাচলের জন্য। তা হচ্ছে না কেন?

মহাসড়ক জুড়েই বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। এসব ট্রাকস্ট্যান্ডে সব সময়ই ট্রাক থেকে পণ্য ওঠানামা করা হয়, কোথাও খালি ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এছাড়া কাভার্ড ভ্যান, কন্টেইনারবাহী টেইলার ও রডবাহী ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে। চার লেনের এই মহাসড়কে প্রায় এক–চতুর্থাংশ এসব যানবাহনের দখলে চলে গেছে। বাস থামার জন্য নির্মিত ৩৩টি বাস–বে নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে। বিভিন্ন জনবহুল এলাকা ও বাজারগুলোতে এসব বাস–বে গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু কোনোটিতেই বাস থামার উপায় নেই। কারণ প্রতিটি বাস–বে দখল করে ট্রাক, টেম্পো, সিএনজি স্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। এসব বাস–বেতে ৪–১০টি পর্যন্ত ট্রাক থেমে থাকে নিয়মিত। ফলে মূল মহাসড়কে থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হয় বিভিন্ন বাসে। এতে মহাসড়কটিতে বিভিন্ন বাজার এলাকায় নিয়মিতই যানজট তৈরি হয়।

হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক ব্যবস্থাকে গতিশীল হচ্ছে না কেন?
ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের কারণে কোনো সময়সূচি মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। ৩/৪ ঘন্টা সময় বেশি লেগে যাচ্ছে। কেবল তাতে মানুষের সময়ই নষ্ট হচ্ছে না, অর্থনীতির জন্য সর্বনাশা প্রভাবও সৃষ্টি করছে এ সমস্যা। প্রতিটি যান্ত্রিক যানবাহনে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল বা সিএনজি ব্যবহৃত হয়, তার প্রায় অর্ধেকটাই অপচয় ঘটে যানজটের কারণে। অথচ চরম বিরক্তিকর এ সমস্যা থেকে যাত্রীদের রেহাই দেয়ার তৎপরতা নেই বললেই চলে। যানজট নিরসনে হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক ব্যবস্থাকে গতিশীল করার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। রাস্তায় যত্রতত্র পার্কিংয়ের লাগাম পরাতে হবে। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের এ দুঃসহ যানজট থেকে যাত্রীদের মুক্ত করতেই হবে।

পঠিত : ১৪৪৩ বার

মন্তব্য: ০