Alapon

নাকবাঃ ফিলিস্তিনিদের সব হারানোর দিন

নাকবা কি?
নাকবা আরবী শব্দ। 'নাকবা' শব্দের অর্থ 'মহাদুর্বিপাক'। এর দ্বারা ১৯৪৮ সালে সংঘটিত ফিলিস্তিন যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনি আরবদের দেশত্যাগকে বোঝানো হয়। এসময় ৭,০০,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি গৃহহীন হয়েছিল। এছাড়াও নাকবা দ্বারা মূল যুদ্ধ এবং ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের উপর প্রভাব ফেলা ঘটনাবলীকেও বোঝানো হয়।

কেন পালন করা হয় নাকবা দিবস?
১৯৪৮ সালের ১৫ মে দখলীকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল রাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি জনগণ হারিয়েছিল তাদের সবকিছু। ফিলিস্তিনি জনগণ ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে দেখে তাই এই দিনটির নাম ''আন-নাকবা'' দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ৩০ মার্চ অবৈধ বসতি নির্মাণের প্রতিবাদ করায় ছয় ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। পরের বছর থেকে ৩০ মার্চ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পরবর্তী ছয় সপ্তাহকে ভূমি দিবস হিসেবে পালন করে আসছে ফিলিস্তিনিরা। কোটি কোটি আরব, মুসলিম এবং অন্যান্য সমাজের সহানুভূতিশীল মানুষ এ দিবস এখনো অনুভব করে। তারা মনে রাখে এই কালো দিন, যেদিন ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করা হয়েছিল আর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ইসরায়েলি রাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালের ১৫ মের ঘটনার পর থেকে সারা মুসলিম বিশ্ব পালন করে থাকে এই দিনটিকে। এই বছর নাকবা দিবসের ৭০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।

সাইকস-পিকট চুক্তিই ডেকে এনেছিলো নাকবাঃ
আজ আমরা যখন নাকবা স্মরণ করি, তখন ফিলিস্তিনিরা যা হারিয়েছিলো তার জন্য শোক করাই যথেষ্ট নয়; পাশাপাশি সেই ক্ষতির মাত্রা ও ধরনটাও বোঝা দরকার, অজস্র মানুষের কাছে এখনো তার কী অর্থ, তাও বোঝা দরকার।

ঔপনিবেশিক ব্রিটেনের সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া শত শত ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরের ধ্বংসস্তূপের ওপর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না। এই সত্য কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। সে সময় একটি আন্তর্জাতিক ‘অনুমোদনের’ বলে ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের ভারও ব্রিটেনের ওপর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নিয়েই সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।

একটা পর্যায়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দুটি প্রধান ঔপনিবেশিক শক্তি। জনগণের জাতীয় মর্যাদার কোনো রকম পরোয়া না করেই তারা এই অঞ্চলকে তাদের স্বার্থমতো ভাগ করে। ১৯১৬ সালে ব্রিটেন আর ফ্রান্সের মধ্যে সম্পাদিত সাইকস-পিকট নামে পরিচিত গোপন চুক্তিই এর বড় উদাহরণ। এ চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন, ফ্রান্স আর রাশিয়া অন্য দেশের ভাগ্য ঠিক করে দেয়। এর মাধ্যমে তারা ফিলিস্তিনকে মূলত একটি আন্তর্জাতিকায়িত অঞ্চলে পরিণত করে। অথচ আগের আন্তর্জাতিক সমঝোতা অনুসারে ফিলিস্তিনের হওয়ার কথা ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের দেশ।

নাকবার জন্য দায়ী কে?
১৯১৭ সালের নভেম্বরের কিছু পরে ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক শীর্ষ ব্রিটিশ ইহুদিবাদীর কাছে একটি গোপন পত্র পাঠান। সেখানে তিনি ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে গণহারে ইহুদি অভিবাসনের জন্য কাজ করে যায়।

১৯৪৭ সালের শেষাশেষি ফিলিস্তিন অঞ্চলে বিরাট ভূমিকা নিতে থাকে জাতিসংঘ। স্থানীয় আরবরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগ। বাকিরা ছিল নবাগত ইহুদি অভিবাসী। একেবারে প্রথমে ফিলিস্তিনি আরবরা ছিল জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ। পরে যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চলে, তাতে ব্রিটেনের ভূমিকা কোনোভাবেই ঢাকা যাবে না। অশুভ প্রক্রিয়ায় ক্রয় ও জবরদখলের ঘটনা ঘটলেও সরল সত্যটি বদলানো যাবে না, জমির মালিকানার বড় অংশই ছিল ফিলিস্তিনিদের।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ—যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের বিপুল চাপের মুখে—১৮১ নম্বর প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।’ এতে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র, একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র এবং অধিকৃত জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে রাখার কথা বলা হয়।

ফিলিস্তিনিরা কেন রাজি হয়েছিলো ইহুদীদের জায়গা দিতে?
যেখানে ১৯৩৭ সালের ব্রিটিশ প্রস্তাবে আরবরা ক্ষিপ্ত হয়েছিল, ১৯৪৭ সালের সিদ্ধান্তে তারা বিপর্যস্ত হলো। কেননা, এখানে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রকে সাড়ে পাঁচ হাজার বর্গমাইল ভূমি দেওয়ার কথা বলা হয়। বিপরীতে মাত্র সাড়ে চার হাজার বর্গমাইল বরাদ্দ হয় ফিলিস্তিনের জন্য—অথচ তারাই ছিল ফিলিস্তিনের ৯৪ দশমিক ২ শতাংশ ভূমির মালিক এবং জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগ। ঘটনা হলো, প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রের মাত্র ৬০০ বর্গমাইল এলাকা ছিল ইহুদিদের অধিকারে। এসব তথ্যের কোনোটাই জাতিসংঘের ৩৩ রাষ্ট্রকে ফিলিস্তিন-বিভাগের পক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত করতে পারেনি।

জাতিসংঘের এ বঞ্চনামূলক বিভাজন সত্ত্বেও ইহুদিবাদী নেতারা চেয়েছিলেন আরও বেশি কিছু। তবু উৎসব করার মতো ঘটনা পেয়ে গেল তারা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে অথবা তাদের সঙ্গে মিলে ইহুদিবাদী রূপরেখাকে বিরাট উদারতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে লেগে গেল।

ফিলিস্তিনি ও আরবরা ভেবেছিল, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বারবার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলে, সেহেতু তাদের চাপে পড়েই ব্রিটেনের কলঙ্কিত নীতি আরবদের পক্ষে ঘুরে যাবে। কিন্তু তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও চরম আঘাতে জেগে ওঠার মুহূর্ত। বিচার ও বিবেকের সব সম্ভাবনা এভাবে তিরোহিত হলো। ফিলিস্তিনিরা যখন আসন্ন যুদ্ধের অনিবার্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তখন ইহুদিবাদী নেতৃত্ব সমগ্র ফিলিস্তিনকেই অধিকার করে নেওয়ার পরিকল্পনা করছিল। সে সময় ইহুদিবাদীদের প্রধান যুদ্ধ-সংগঠন ছিল হাগানাহ, একে পরিচালিত করত জুইয়িশ এজেন্সি। এই এজেন্সি তখন থেকেই সরকার হিসেবে কাজ করা শুরু করে, আর হাগানাহ হয়ে ওঠে তার সামরিক বাহিনী। এর মধ্যে ১৯৪৬ সালে ইঙ্গ-মার্কিন কমিটি হিসাব করে দেখে, ইহুদিদের রয়েছে ৬২ হাজার সুপ্রশিক্ষিত যোদ্ধা। আরবদের প্রস্তুতি বিষয়ে তারা তখন কিছুই বলেনি।

বসতি গড়েই শুরু করে ফিলিস্তিনি নিধন ও বিতাড়নঃ
জাতিসংঘের মাধ্যমে দেশভাগ পরিকল্পনা পাস হওয়ামাত্রই ফিলিস্তিনি নিধন ও বিতাড়ন শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে স্বদেশের ইহুদিবাদী বিভাজনের প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি গণবিক্ষোভকে দাঙ্গা বলে আখ্যায়িত করে ইহুদিবাদীরা সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। এরই ধাক্কায় এক লপ্তে ৭৫ হাজার ফিলিস্তিনি দেশত্যাগ করে।

আরবদের নিষ্ক্রিতায়ই আজ ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের কারণঃ
আরবদের সহযোগিতা এত বিলম্বে আসে যে ফিলিস্তিনিরা আরও মুষড়ে পড়ে। তারা হয়ে পড়ে সবচেয়ে অরক্ষিত জনগণ। আরও লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়। তারা হারায় তাদের সর্বস্ব, হয়ে পড়ে সব দিক থেকে বিপন্ন।

এ ঘটনার পরিণতিতে আর যা যা ঘটেছিল, তা খাটো করা যাবে না। হাজার হাজার মানুষের জীবন গেছে। মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে শত শত গ্রাম। ফিলিস্তিনিদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতির মধ্যে ধুঁকছে। তারা লড়াই করছে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দুর্দশা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে।

নাকবা ও মার্কিনিদের ন্যাক্কারজনক পরিকল্পনাঃ
'নাকবা দিবস'কে ঘিরিয়া দুই পক্ষে প্রতিবারই চরম উত্তেজনা হয়, যা কয়েকদিনের মধ্যেই আবার থেমেও যায়। কিন্তু এবার সে উত্তেজনায় ঘি ঢালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে তার কথা অনুযায়ী গত ১৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়। মুসলিমদের বিপর্যয়ের দিনে ৭০ বছর পূর্বের স্বাদের মত আরো একটি স্বাদ নিতে চাচ্ছে ইসরাইল। আর এসব দিক বিবেচনা করেই ফিলিস্তিনিরা জেগে উঠেছে। 

যুগে যুগে নাকবা ও ২০১৮ সালের নাকবাঃ
প্রতি বছরই ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজাতে মিছিল, সমাবেশ, গণসঙ্গীত, ৬৫ সেকেন্ড ধরে সাইরেন বাজানোর আয়োজনসহ নানাবিধ কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছিলো। ইহাছাড়াও ইতিপূর্বে এইদিন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ করতে গিয়ে ইসরাইল কর্তৃপক্ষের হাতে আটক হয়েছে বহু ফিলিস্তিনী। জর্দান, লেবানন, সিরিয়া, মিসরসহ আশেপাশের দেশগুলিতে দশকের পর দশক ধরে গড়ে উঠা ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে 'নাকবা দিবস' পালিত হয়ে আসছিলো; নানান স্থানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহিত সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছিলো।

কিন্তু গতকালের নাকবার মতো ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ইতিপূর্বে আর কখনোই হয় নি। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর একদিনে এত সংখ্যক ফিলিস্তিনি নিহতের ঘটনা এটাই প্রথম। আল-জাজিরার ভাষ্যমতে, গতদিনে মোট শহীদ হয়েছেন ৫২ জন, শিশু নিহতঃ ৬ জন, কন্যা শিশু নিহতঃ ১ জন, আহত শিশুঃ ২০৩ জন, আহত নারীঃ ৭৮ জন, মোট আহতঃ ২৪১০ জন, মাথায় আঘাত প্রাপ্তঃ৭৯, গুরুতর আহতঃ ১৬১ জন, বুকে ও পিঠে আঘাত প্রাপ্তঃ ৬২ জন, পাকস্থলিতে আঘাত প্রাপ্তঃ ৫২ জন, টিয়ারশেলে আঘাত প্রাপ্তঃ৮৩৭ জন, মেডিকেল অফিসার আহতঃ ১ জন, সাংবাদিক আহতঃ ১২ জন।

শেষ কথাঃ
নাকবা দিবস তাই কেবল স্মরণের বিষয় নয়। এটা এমন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে, কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ থেকে পৃথিবী বেরিয়ে আসতে পারে। আর কোনো কিছুই এর মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। অনলাইনে বিশেষ করে টুইটারে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে পারি আমরা। 

ফিলিস্তিনিরা মুসলিম উম্মাহর প্রিয় ভূমি এবং নিজেদের জন্মভূমিকে রক্ষা করতে প্রতিনিয়ত জীবন দিয়ে চলেছেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ বাদ যাচ্ছেনা নারীরাও। আল্লাহ তাদের রক্তকে কবুল করে প্রিয় ভূমিকে আবারো মুসলিমদের নিয়ন্ত্রনে এনে দিন।

পঠিত : ১৩৭৩ বার

মন্তব্য: ০