Alapon

চাঁদ দেখে রোযা রাখার অর্থ কি? তা নিয়ে বিভ্রান্তির সমাধান কি?

রসূলুল্লাহ সা. চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোযা শুরু করতে এবং চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোযা শেষ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোযা রাখো এবং চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোযা ভাংগো। চাঁদ দেখা না গেলে মাস ত্রিশদিনে পূর্ণ করো। সুতরাং রমযানের রোযা শুরু করা এবং রোযা শেষ করে ঈদ করা এ দুটোর জন্যেই চাঁদ দেখা জরুরি।

রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: তোমরা রোযা রাখো চাঁদ দেখার ভিত্তিতে এবং রোযা ভাংগো (অর্থাৎ রমযানের রোযা রাখা শেষ করো) চাঁদ দেখার ভিত্তিতে। তবে আকাশ মেঘে ঢাকা থাকার কারণে চাঁদ যদি তোমাদের কাছে গোপন থাকে তবে শাবান মাস ত্রিশ দিনে পূর্ণ করো। 
(সূত্র: সহিহ বুখারি, হাদিস-১৯০৯। সহিহ মুসলিম, হাদিস-১০৮১। ইবনে উমর সূত্রেও অনুরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, হাদিস-১৯০৭। সহিহ মুসলিম, হাদিস-১০৮০)

হাদিসটির ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তিনটি মত ও পথ সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলো হলো:

মত-১: প্রত্যেক স্বাধীন সার্বভৌম দেশে রোযা ও ঈদ করবে, সে দেশের কোথাও চাঁদ দেখা যাওয়ার ভিত্তিতে।

মত-২: দ্বিতীয় মতটি হলো, মুসলমানদের কিবলা যেহেতু মক্কায় অবস্থিত, সে কারণে সেখানে যেদিন চাঁদ দেখা যাবে এবং সেখানে যেদিন রোযা শুরু হবে, সেখানে যেদিন ঈদ হবে, সারা পৃথিবীর মুসলিমদের সেদিনই রোযা ও ঈদ করা উচিত।

মত-৩: তৃতীয় মত হলো, চাঁদ যেহেতু একটি এবং প্রতি মাসে পৃথিবীতে একদিনই নতুন চাঁদ দেখা যায়, তাই পৃথিবীর যে কোনো স্থানে চাঁদ দেখা গেলেই পৃথিবীর সব দেশে রোযা ও ঈদ করা উচিত। এ মতের লোকেরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিতে বলছেন, পৃথিবীতে কোন্ মাসে কখন চাঁদ দেখা যাবে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিতে পূর্ব থেকেই তার ক্যালেন্ডার তৈরি করে রাখা উচিত। এতে করে পৃথিবীর সব মানুষ পূর্ব থেকেই জানতে পারবে, তারা কবে রোযা রাখবে এবং কবে ঈদ করবে।

এই তিনটি মতের সবগুলোর ভিত্তিই হলো উপরোক্ত প্রথম হাদিসটি।
প্রথম মতটি প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে তাতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

দ্বিতীয় মতটি পোষণ করেন কিছু কিছু মুসলিম গ্রুপ।

তৃতীয় মতটি বিজ্ঞানসম্মত এবং যৌক্তিক। বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিরা এ মতকেই সঠিক মনে করেন।

উপরে বর্ণিত হাদিস থেকে স্পষ্ট জানা গেলো, রমযানের রোযা শুরু এবং শেষ করতে হবে চাঁদ দেখে। কিন্তু মেঘমালা এবং অন্যান্য কারণে কখনো কখনো চাঁদ নাও দেখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রসূল সা. মাস ত্রিশ দিনে পূর্ণ করতে বলেছেন। এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অতি অবিশ্যি বিবেচ্য:

০১. রোযা শুরু করা এবং শেষ করার শরয়ি বিধান হলো নতুন চাঁদ উদয় হওয়া এবং তা দেখতে পাওয়া।

০২. চন্দ্র মাসের সূচনা হবে পৃথিবীতে চাঁদ উদিত হওয়া এবং তা দেখা যাওয়ার ভিত্তিতে।

০৩. কিন্তু ‘হালতে ইদতেরার’ অর্থাৎ বাধ্য হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হলে ‘অনন্যোপায়’ সংক্রান্ত বিধি প্রযোজ্য হবে। যেমন: খাদ্যের অভাবে জীবনহানির আশংকা দেখা দিলে হারাম ভক্ষণের অনুমতি আছে। ঠিক সেভাবে আকাশ মেঘে ঢাকা থাকা এবং সে কারণে চাঁদ দেখতে না পাওয়ার অবস্থা দেখা দিলে ‘চাঁদ উদিত হয়নি’ -এ বিধি প্রযোজ্য হবে।

০৪. সালাতের ওয়াক্ত শুরু হওয়া এবং শেষ হবার বিষয় কিন্তু সূর্যোদয়, সূর্য হেলা ও সূর্যাস্তের উপর নির্ভরশীল। সে ক্ষেত্রেও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে রসূল সা. ‘অনন্যোপায়’ বিধি প্রয়োগ করতে বলেছেন।

০৫. কিন্তু কালের আবর্তনে মানুষের জ্ঞান, গবেষণা, উদ্ভাবণ ও আবিষ্কারের ফলে মহাজ্ঞানী আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্টি রহস্য মানুষের কাছে ক্রমান্বয়ে উন্মুক্ত হতে থাকবে বলে তিনি আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ্ বলেন:

وَالْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً وَيَخْلُقُ مَا لَا تَعْلَمُونَ– 
وَعَلَى اللهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ وَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ –

অর্থ: তোমাদের আরোহণ এবং সৌন্দর্যের জন্যে তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা। তিনি (তোমাদের কল্যাণে) আরো এমন সব জিনিস সৃষ্টি করবেন, যা তোমরা জানোনা। সঠিক পথ দেখানো আল্লাহর দায়িত্ব, যেহেতু অনেক বক্র পথ রয়েছে। তিনি চাইলে তোমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করতেন। (সূরা ১৬ আন নহল: আয়াত ৮-৯)

سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ ۗ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ –

অর্থ: আমরা অচিরেই তাদের দেখাবো আমাদের নিদর্শনাবলি মহাবিশ্বে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে, তখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এ (কুরআন) এক মহাসত্য। তোমার প্রভুর ব্যাপারে কি একথা যথেষ্ট নয় যে, তিনি প্রতিটি বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী? (সূরা ৪১ হা-মিম আস্ সিজদা: আয়াত ৫৩)

এ আয়াতগুলোতে মানুষের জ্ঞান-গবেষণা, উদ্ভাবন ও আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

০৬. গবেষণা উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের ফলে বর্তমানকালের মানুষের কাছে সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদের গতি প্রকৃতি সংক্রান্ত জ্ঞান অনেকটাই উন্মুক্ত হয়েছে। এর ফলে একদিকে মানুষের জাগতিক বিষয়াদির ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনা প্রণয়ন, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা পরিচালনা এবং সময় মেনটেইন যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি দীনি ও শরয়ি বিধিবিধান পরিপালন এবং বাস্তবায়নও সহজ হয়েছে।

০৭. এরই ফলে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝড়-বাদল ও মেঘ-বৃষ্টির দিনে সালাতের সময় নির্ধারণে এখন আর আমাদেরকে সূর্যের প্রভাত রেখা, দুপুর গড়িয়ে পড়া, কিংবা সূর্যাস্ত জানার জন্যে সরাসরি সূর্যের দিকে তাকাতে হয়না; এরই ফলে মেঘবাদলের দিন সিয়ামের জন্যে সাহরি খাওয়া, কিংবা ইফতার করার জন্যেও সরাসরি সূর্যকে অনুসরণ করতে হয় না এবং এসব ক্ষেত্রে অনন্যোপায় অবস্থারও সম্মুখীন হতে হয়না। বরং এসব ক্ষেত্রেই আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে আবিষ্কৃত ক্যালেন্ডার, সময় ও ঘড়িকেই অনুসরণ করি। এই অনুসরণ করাকে আমরা এবং আমাদের উলামায়ে কেরাম হারাম কিংবা না জায়েয মনে করিনা।

০৮. সালাতের সময় শুরু ও শেষ হওয়া, সাহরি খাওয়ার শেষ সময় জানা এবং ইফতারির সময় জানার জন্যে যেমন আমরা সরাসরি সূর্যকে নয়, বরং সরাসরি ঘড়িকে (পরোক্ষভাবে সূর্যকে) অনুসরণ করি, সেক্ষেত্রে ফরজ রোযার মাস রমযানের সূচনা ও শেষ জানার জন্যে আর ঈদের দিন, আরাফার দিন এবং কুরবানির দিনগুলোর সঠিক তারিখ নিশ্চিত হবার জন্যে বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারিত ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা কি অত্যাবশ্যক নয়?

০৯. আমাদের মনে রাখতে হবে, মেঘাচ্ছন্ন দিনে চাঁদ না দেখা যাওয়া, কিংবা কোনো এলাকায় দেখা যাওয়া আর কোনো এলাকায় না দেখা যাওয়া এবং সরাসরি চাঁদ না দেখা যাওয়ার ফলে রোযা সঠিক দিনে শুরু এবং শেষ করতে না পারা এখন আর কোনো ওজর, ইদতেরার বা অক্ষমতা ও অনন্যোপায়-এর বিষয় নয়।

১০. চাঁদ দেখে রোযা রাখা এবং চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গার বিষয়ে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোর যথাযথ অনুসরণের জন্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ধারিত ক্যালেন্ডার অনুসরণই সর্বাধিক উপযোগি ও যুক্তিযুক্ত সমাধান।

১১. তবে এই বাস্তবতা ও যৌক্তিকতা সারা বিশ্বের উলামায়ে কেরামকে বুঝতে হবে এবং তাদের মেনে নিতে হবে।

১২. আলেমগণ ঐক্যমতে না পৌঁছা পর্যন্ত মতপার্থক্য ও বিভেদ থেকেই যাবে।

১৩. কিন্তু কোনো অবস্থাতেই মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ উস্কে দেয়া যাবেনা, বরং যে এলাকার লোকেরা যে মত অনুসরণ করতে চায় আপাতত করতে থাকুন। আর

১৪. তৃতীয় মতের লোকেরা তাদের যৌক্তিকতাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করতে থাকুন এবং মুসলিম জনগণ ও আলেমগণকে বুঝাতে থাকুন। এর ফলে অচিরেই একদিন এ মত গৃহীত হয়ে যাবে। এভাবে কাজটি করতে হবে পর্যায়ক্রমে নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে।

আল্লাহ পাক আমাদেরকে কুরআন ও হাদিসের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করার এবং তা অনুসরণ করার তওফিক দান করুন। 

পঠিত : ১৭২১ বার

মন্তব্য: ০